'কারো বাবা ডাক শুনলেই আমার সন্তানেরা ডুকরে কেঁদে ওঠে’


দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে ঘোর অমানিশার অন্ধকারে দিন কাটছিল শহিদ ফারুকের স্ত্রী সীমা আকতারের। এখন তাঁর বিশ্বাস, সরকারের সহযোগিতা এবং তাঁদের চেষ্টায় সেই আঁধার কাটিয়ে একদিন আলোর মুখ দেখবে তাঁর পরিবারটি।

কম বয়সে বিধবা হওয়া সীমা হয়তো আর কখনও পাবেন না স্বামীর যত্ন-ভালোবাসা। অবুঝ দুই সন্তান কোনোদিনও ফিরে পাবে না তাদের পরম আরাধ্য বাবাকে। বুকের ভেতরে গভীর কষ্ট চেপে রেখে তাদের জীবনের দিনগুলো কাটবে। দুই সন্তান লেখাপড়া করে স্বাবলম্বী হলে একদিন হয়তো এ ছোট্ট ঘরটি অনেক বড়ো হবে। 

কোটা আন্দোলনের শহিদ, ফার্নিচার মিস্ত্রি মো. ফারুকের পরিবারের জন্য স্ত্রী সীমা আকতারের মতো এমন প্রত্যাশা এদেশের লক্ষ-কোটি মানুষের। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে একটি নতুন বাংলাদেশের অন্যতম নির্মাতা ফারুকের পরিবারের জন্য এ প্রার্থনা পুরো দেশবাসীর।

পেশায় ফার্নিচার মিস্ত্রি মো. ফারুকের বয়স ছিল ৩২ বছর। গত ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের মুরাদপুর এলাকায় পুলিশ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের সাথে কোটা আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে শহিদ হন তিনি। 

পরিবার ও কর্মস্থল সূত্রে জানা যায়, ফারুক ওইদিন দুপুরে তাঁর কর্মস্থল মুরাদপুরস্থ শাহজালাল ফার্নিচারের দোকান হতে কাজ করে দুপুরের খাবার খেতে যান কাছের বিসমিল্লাহ হোটেলে। সেখান থেকে ফেরার পথে হঠাৎ করে দু’টি গুলি তাঁর বুকের বাম পাশে এবং পিঠে লাগে। গুলি লাগার পর ফারুক হেঁটে তাঁর কর্মস্থলে ফেরার চেষ্টা করেন। কিন্তু অল্প কিছ ুদূর যাওয়ার পর তিনি আইল্যাণ্ডের মাঝখানে পড়ে যান। এ সময় ওই পথে যাচ্ছিলেন হাটহাজারী মাদ্রাসার দুই ছাত্র। তাঁরা ফারুককে রক্তাক্ত ও গুলিবিদ্ধ দেখে তাঁকে নিয়ে একটি রিক্শায় ওঠেন। কিন্তু চারিদিকে গোলাগুলি ও সংঘর্ষের কারণে তাঁরা যেতে বাধা পাচ্ছিলেন। এপথ-ওপথে অনেক্ষণ ঘুরে ফারুককে নিয়ে তাঁরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছান। 

এদিকে, কর্মস্থল শাহজালাল ফার্নিচারের মালিক ঘটনাটি শুনে দ্রুত লালখানবাজারে ফারুকের বাসায় গিয়ে তাঁর স্ত্রী সীমা আকতারকে খবর দেন। ফারুকের স্ত্রী ফোনে তাঁর বাবা ও ভাইকে ঘটনাটি জানান। সীমার ভাই দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে যান। রক্তে ভেজা শার্ট দেখে প্রথমে চিনতে না পারলেও পরে চেহারা দেখে ফারুককে শনাক্ত করেন তিনি। এর অল্প কিছু সময়ের মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছান ফারুকের স্ত্রী সীমা আকতার। 

সীমা আকতার বলেন, ‘মাদ্রাসার ওই দুই ছাত্র আহত ফারুককে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছেন। আমার স্বামী একজন অপরিচিত ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে এবং অনেক চেষ্টা করে মেডিকেল নিয়ে এসেছিলেন। আমি তাঁদের মুখে শুনেছি, হাসপাতালে নেয়ার পরও আমার স্বামীর জ্ঞান ছিল। কিন্তু ডাক্তাররা তাঁর চিকিৎসার চেষ্টা না করে তাঁকে ইমার্জেন্সির একটি বেডে রেখে দিয়েছিলেন। এর আরো ঘণ্টাখানেক পরে, বিকেল ৪ টার দিকে ফারুক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।’

স্বামী সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন সীমা আক্তার। বলেন, ‘ফারুক ছিল অমায়িক এবং অনেক ভালো একটা ছেলে। আমাদের পরিচয় হয় ১৫-১৬ বছর আগে। এরপর আমাদের বিয়ে হয়। সে গত ১৫ বছর যাবত নগরীর মুরাদপুরে শাহজালাল ফার্নিচারের দোকানে কাজ করতো। সে কখনো আমাকে কোনো কাজ করতে দেয়নি। ফারুক একা কাজ করে অনেক কষ্ট করে সংসার চালাতো। আমাকে বলতো, আমি যেন আমার ছেলে-মেয়েকে ভালোমতো পড়ালেখা করাই। ঠিকমতো স্কুলে আনা-নেয়ার কাজটি করি। কিন্তু এখন সে আর নেই।’

সীমা কথা বলছিলেন এবং তাঁর দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি ঝরছিল। এ সময় ৭ বছরের ছোট্ট ফাহিমা মায়ের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে ছিল। 

হতাশ কণ্ঠে সীমা বলেন, ‘আজ আমার ছেলে-মেয়ে দুটি সারাজীবনের জন্য বাবা-হারা হয়ে গেল। তারা আর কখনো বাবার আদর পাবে না। এখনও পাশের বাসার কারো বাবা ডাক শুনে অনেক সময় তারা ডুকরে কেঁদে ওঠে। এখন আমাকেই সারাজীবন তাদের বাবা-মায়ের স্থান পূরণ করতে হবে।’ 

তথ্যসূত্র: বাসস

#Tales_of_July

Post a Comment

Previous Post Next Post