অন্তহীন ভোগান্তিতে শহীদ ইমনের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী

 

জুলাই অভ্যুত্থানে মো. ইমনের মৃত্যুর পর তার তিন সদস্যের পরিবার- মা, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও পাঁচ বছর বয়সী ছেলে এখন অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। তারা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি। জীবিকা নির্বাহের কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না তারা।

২৬ বছর বয়সী রাবার কারখানার শ্রমিক ইমন গত বছরের ১৯ জুলাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রায়েরবাগ বাসস্ট্যান্ডের কাছে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তখন দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলছিল, যে আন্দোলনে শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। ৫ আগস্ট তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যান।

ইমনের স্ত্রী ২৪ বছর বয়সী একজন পোশাক শ্রমিক মুনসুমা তখন দেড় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর জীবিকার তাগিদে শ্বাশুড়ি জুসনা বেগমসহ তিন সদস্যের সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থাতেও পোশাক কারখানায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

মুনসুমা বলেন, ‘আমার স্বামী তখন অসুস্থ ছিল, তাই সংসার চালাতে আমি তার শহীদ হওয়ার দুই-তিন মাস আগেই গার্মেন্টসে কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু তার মৃত্যু আমাকে গর্ভাবস্থায়ও কাজ চালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।’

কিন্তু সন্তান প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসায় দেড় মাস আগে তাকে চাকরি ছাড়তে হয়।

তিনি বলেন, ‘আমরা এখন ভয়াবহ সংকটের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। সংসারের কোনো আয়ের উৎস নেই। আমার সন্তান জন্মের পর খরচ কীভাবে চালাব, কিছুই জানি না।’ এমন অনিশ্চয়তার মাঝে ইমনের মা জুসনা (৪৫) দিনমজুর হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছেন।

কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা ইমনের পরিবার জন্মগতভাবেই ভূমিহীন-গৃহহীন। তার তিন ভাই ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে বড় হয়েছেন। সম্প্রতি ইমনের পরিবার পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, রাজধানীর মাতুয়াইল দক্ষিণপাড়ায় একটি টিনশেড ঘরে সামান্য পার্টিশন দিয়ে তারা বসবাস করছেন।

জুসনা জানান, বাড়িভাড়া বাবদ প্রতি মাসে চার হাজার টাকা দিতে হয়। এছাড়া ইমনের ছেলে মো. ইফরানের মাদ্রাসার খরচও রয়েছে। ‘বউমা চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর আমি বাধ্য হয়ে দিনমজুরের কাজ করছি। কিন্তু তাতে সংসার চলে না,’ বলেন তিনি।

ইমনের দুই ভাই ভিন্ন জায়গায় থাকেন। বড় ভাই সোহাগ চট্টগ্রামে এবং মেজো ভাই সজীব যাত্রাবাড়ীতে নিজ নিজ পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। ‘ওরা নিজেরাও টানাটানির মধ্যে আছে। কিন্তু ইমনের ভালো চাকরি ছিল, ভালো বেতন পেত। তাই সে আমাকে নিজের কাছে রেখেছিল,’ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন জুসনা।

এদিকে, ইমনের স্ত্রী ও মায়ের চোখেমুখে শুধু অনিশ্চয়তা আর হতাশার ছাপ। কান্নাজড়িত কণ্ঠে জুসনা বলেন, ‘আমার অনাগত নাতির নিয়তি হলো সে এতিম হয়ে জন্ম নেবে।’ আর মুনসুমা বলেন, ‘আমার সন্তানের জন্য কী অপেক্ষা করছে, জানি না।’

সরকারি সহায়তার আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না, কীভাবে সংসার চালাব, সন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে। সরকারের উচিত আমাদের সাহায্য করা।’

শাহাদাতের স্মৃতি

এখনও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে কোনো সহায়তা পায়নি ইমনের পরিবার। তবে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তারা দুই লাখ টাকা পেয়েছিল, যা দিয়ে কিছুদিন সংসার চালিয়েছেন।

ইমনের মৃত্যুর দিনের কথা স্মরণ করে তার মা বলেন, ‘১৯ জুলাই আসরের নামাজের সময় সে বাসা থেকে বের হয়েছিল মজুরি নিতে, কারণ সেদিন নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু কেনারও টাকা ছিল না। কিন্তু ফেরার পথে রায়েরবাগ বাসস্ট্যান্ডের কাছে গুলিবিদ্ধ হয়।’

তার আগের দিনই ইমন জানায় যে ১৮ জুলাই আন্দোলনে ১৯ জন নিহত হয়। তখন মা তাকে বলেন, ‘বাবা, তুমি আন্দোলনে যেও না, তুমি আমাদের একমাত্র ভরসা।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে জুসনা বলেন, ‘আমার ছেলে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। সে ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। কিন্তু এক গুলি আমাদের পরিবার ধ্বংস করে দিল।’

ইমন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তার এক সহকর্মী ফোন করে খবর দেন। সহকর্মী ও কয়েকজন ছাত্র তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

লাশ ফিরে পেতে দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা

ইমনের লাশ পেতে পরিবারকে চরম হয়রানির শিকার হতে হয়। ‘হাসপাতাল ও পুলিশ আমাদের কোনো সহায়তা করেনি, বরং লাশ লুকিয়ে ফেলতে চেয়েছিল,’ বলেন জুসনা।

কদমতলী থানায় সহযোগিতা চাইতে গেলে এক পুলিশ সদস্য সজীবকে বলেন, ‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে থানা ছাড়ো, নইলে তোকেও গুলি করব।’

পরবর্তীতে তারা যাত্রাবাড়ী থানায় গেলেও কোনো সাহায্য মেলেনি। অবশেষে শাহবাগ থানা থেকে সাধারণ ডায়েরি করার পর পোস্টমর্টেম শেষে ২২ জুলাই রাত ১টা ৩০ মিনিটে মরদেহ পান তারা। তবে এর জন্য বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করতে হয়।

‘মনের মজুরি বিকাশ অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছিল, কিন্তু তার ফোন চুরি হয়ে যায়। ফলে আমরা টাকাও তুলতে পারিনি। শেষমেশ সজীব ৩০ হাজার টাকা ধার করে বিভিন্ন জায়গায় খরচ করে লাশ ছাড়িয়ে আনে,’ বলেন জুসনা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের কিছু কর্মচারী চড়া দামে অ্যাম্বুলেন্স সরবরাহ করে, সেটিও নিতে বাধ্য হন তারা। ‘আমরা প্রযুক্তির ব্যবহার জানি-বুঝি না। ইমনের ফোন নম্বরে কল দিলে এক ব্যক্তি বলত, ‘ফোন ফিরিয়ে দেব’। ‘কিন্তু সে দেয়নি।’

বিচারের দাবি

ইমনের শহীদ তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কি না, তা জানেন না পরিবারটি। তবে অনেকে তাদের কাছ থেকে নথিপত্র সংগ্রহ করেছে।

কঠোর পরিশ্রম করে সন্তানদের বড় করেছেন বলে জানিয়ে জুসনা বলেন, ‘তিন ছেলে মানুষ করেছি, স্বামী মারা যাওয়ার পর কত কষ্ট করেছি। ইমন তখন মাত্র পাঁচ বছর বয়সী ছিল।’ 

৩০ বছর ধরে ঢাকায় বসবাসরত এই নারী এখন শুধু একটাই চায় ছেলের হত্যার বিচার। ‘আমার ছেলের খুনিদের ফাঁসি চাই,’ বলেন তিনি।

সংবাদ: বাসস

#Tales_of_July

Post a Comment

Previous Post Next Post