আরিফের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেষে চাকরি করে পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার। এ আশায় বুক বেঁধে প্রবল আগ্রহ নিয়ে লেখাপড়াও চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস একটি বুলেট তার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।
আরিফ হোসেনের বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের শালিয়াবহ গ্রামে। বর্তমানে নিজের চিকিৎসা ও সংসারের খরচের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে চোখে-মুখে যেন অন্ধকার দেখছেন। কবে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবেন তাও জানেন না। বলতে গেলে তিনি এখন পরিবারের বোঝা ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেওয়ার পর পুলিশের ছোড়া গুলি পিঠে বিদ্ধ হয় তার। বুলেট বুকের পাঁজর ভেদ করে বাম হাতের ডানা ছিদ্র করে বেরিয়ে যায়। খাদ্যনালীও ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার। সেদিন আরিফ ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেছেন।
কিন্তু ৫০ দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে তাকে। এখন বাড়ি ফিরেছেন। খাবার খাওয়ার পরেই পেটে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে হয় তাকে। এ ব্যথা প্রায় দুই ঘণ্টা স্থায়ী হয়।
রসুলপুর গ্রামের মৃত আবুল কাশেম ও আন্না খাতুনের দুই ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে আরিফ। তিনি এ বছর ধলাপাড়া কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৪.০৮ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
আরিফের বাবার মৃত্যুর পর তার মা অসুস্থ থাকার কারণে তাকে বিয়ে করতে হয়েছে। আরিফের স্ত্রী ও দেড় মাসের একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান রয়েছে।
টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের শালিয়াবহ গ্রামে গিয়ে আরিফ হোসেনের বাড়ি কোনদিকে জানতে চাইলে এলাকার লোকজন তার বাড়িতে নিয়ে যায় এ প্রতিবেদককে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, একটি টিনের ঘরে আরিফের পরিবারের বসবাস।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আরিফ হোসেন বলেন, শুরু থেকেই আমি ঘাটাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেই। গত ১৯ জুলাই চাচাতো ভাই রায়হান সিঙ্গাপুর চলে যাবে বিধায় তাকে নিয়ে ঢাকায় এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেই। এরপর আমি সেই দিন ঢাকায় থেকে যাই।
পরের দিন বন্ধুদের সঙ্গে উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেই। সেদিন আমরা বিভিন্ন স্কুল-কলেজের প্রায় ৬০ ছাত্রছাত্রী ছিলাম।
আমরা যখন মিছিল করতে শুরু করি তখন হঠাৎ দেখি তিনটি পুলিশের গাড়ি আসে ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। আমাদের মিছিল লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। হঠাৎ একটি গুলি আমার পিঠে বিদ্ধ হয়ে বুকের পাঁজর ভেদ করে হাতের ডানা ছিদ্র করে বেরিয়ে যায়। এরপর আমি আর কিছুই জানি না।
তিনি বলেন, কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি গুলিটি ফুসফুসের কিছু অংশ ছিদ্র হয়ে বেরিয়ে গেছে। যার কারণে অপারেশনের মাধ্যমে ফুসফুসের কিছু অংশ কেটে ফেলতে হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দীর্ঘ ৫০ দিন চিকিৎসা শেষে গত ৯ সেপ্টেম্বর বাড়ি ফিরি। এখন বাড়ি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছি।
ডাক্তার বলেছে, আরও তিন বছর চিকিৎসা করাতে হবে। আমি শুধু ১৪ আগস্ট থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারি খরচে চিকিৎসা সুবিধা পেয়েছি। আমার পরিবারে মা, নানী, স্ত্রী-সন্তানসহ ৫ জন রয়েছে। সংসারের খরচ বহন করে পরিবারের পক্ষে আমার চিকিৎসা খরচ বহন করা সম্ভব হচ্ছে না।
আরিফের মা আন্না খাতুন (৫০) জানান, গত ২০ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেয় আরিফ। পুলিশের গুলিতে আহত হলে তাকে প্রাথমিক অবস্থায় ১৩ নম্বরে উত্তরা স্পেশালিস্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রথম দফায় অপারেশন শেষে আইসিইউতে রাখা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে পরের দিন আরিফকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে দ্বিতীয় দফায় অপারেশন করা হয়।
তখন ডাক্তাররা জানান, গুলি লাগার কারণে আরিফের ফুসফুসের একটি অংশ ছিদ্র হয়ে গেছে। এ জন্য কিছু অংশ কেটে ফেলতে হয়। এ ছাড়াও খাদ্যনালী ছিঁড়ে গেছে। এর পর তৃতীয় দফায় অপারেশন করা হয়। তখন আমরা সবাই ভেবেছিলাম ও আর বাঁচবে না। সবার দোয়ায় আল্লাহ ওকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
তিনি আরও জানান, ঢাকায় চিকিৎসার সময়ে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এ খরচ আমার পরিবারের একার পক্ষে বহন করা সম্ভব ছিল না। এ পরিস্থিতিতে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধারকর্য করতে হয়েছে। এই ঋণই এখনো শোধ করতে পারিনি। তারপর আরিফের চিকিৎসা, ওষুধপত্র কেনা, সংসারের খরচ বহন করে আমি এখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘাটাইলের অন্যতম সমন্বয়ক রাকিবুল হাসান রাকিব জানান, আরিফের চিকিৎসা বাবদ অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। পুরোপুরি সুস্থ হতে এখন আরও অর্থের প্রয়োজন। পরিবারের পক্ষে এ অর্থের যোগান দেওয়া খুবই কষ্টকর ব্যাপার। আমরা বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে আরিফের বিষয়ে আবেদনপত্র জমা দিয়েছি। এ ছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে কেউ যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত তাহলে আরিফকে সুস্থ করতে অনেক সহজ হতো। সেও তার স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যেতে পারত।
দৈনিক আমার দেশ পত্রিকাকে আরিফ জানান, তিনি নিয়মিত চিকিৎসা নিতে এখন বেশ হিমশিম খাচ্ছেন। তার কাছে ওষুধ কেনার টাকাও নেই। যে কোনো প্রকার সাহায্যের আশায় তিনি আমার দেশ-এর মাধ্যমে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
#Tales of July
Post a Comment