গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ছে আমার পেছনে থাকা ছেলেটা..






নিজের নামের মতোই যাবতীয় 
মুগ্ধতা নিয়ে সে চলে গেলো অস্তাচলে..

স্লোগানে স্লোগানে আমরা হাউসবিল্ডিং হয়ে এগিয়ে যাচ্ছি বিএনএসের দিকে। আজমপুর বসবো। বিএনএস সেন্টার পার হতে পারছি না। পুলিশ ব্যারিকেড তৈরি করছে। এগোতে দেবে না। মুহূর্তেই সাউন্ড গ্রেনেডে কেঁপে উঠছে চারদিক। টিয়ারগ্যাস ধেয়ে আসছে অনবরত।

দাঁড়িয়ে থাকা হয়ে উঠেছে অসম্ভব।

আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। চোখে জ্বালাপোড়া। কাউকেই দেখছি না। শ্বাস নিতে পারছি না।

গলার ভেতর অবধি জ্বলে যাচ্ছে।

আমরা কি তবে মরে যাচ্ছি?

আমরা হেরে যাচ্ছি?

আমরা কি দাঁড়াতে পারবো না?

কাউকে কি পাশে পাবো না?

এতকিছু কি ভাবতে পারছিলাম তখন?— জানি না। হয়তো ভেবেছিলাম, হয়তো না। ততক্ষণে আমাদের বোনেরা ছুটে এসেছে। অচেনা অথচ চিরচেনা এক বোন দ্রুত এগিয়ে আসলেন। একটানে ছিঁড়ে ফেললেন তার ওড়না। কয়েক টুকরো করে ফেললেন তা। বাড়িয়ে দিলেন আমাদের দিকে।

নাকমুখ বেঁধে ফেলেন— কী গভীর মমতা নিয়ে উচ্চারণ করলো। ব্যাগ থেকে টুথপেস্ট বের করে দিয়ে বললেন, মুখে মাখেন। ততক্ষণে রাস্তায় আগুন জ্বলে ওঠছে। এইসব আগুন বেঁচে থাকবার। কেউ একজন বললেন, ধোঁয়ার কাছে আসুন।

কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আবার এগিয়ে গেলাম। টিয়ারগ্যাস থামছে না। ফার্মেসি থেকে ভাইয়েরা এসে মাস্ক বিলানো শুরু করলেন।

তবুও কি কুলিয়ে ওঠা যায়?


আমরা এগিয়ে যেতে থাকি।

মুহূর্তেই একেকজনের শরীর থেকে রক্তঝরা শুরু হল। পুলিশ গুলি শুরু করেছে।

রিক্সাগুলো বিরামহীন ছুটে চলছে বিএনএস থেকে আরইউএমসি, আরইউএমসি থেকে বিএনএস; ছুটে চলছে আজমপুর থেকে ক্রিসেন্ট, ক্রিসেন্ট থেকে আজমপুর। প্রতি রিকশায় রক্তাক্ত শরীর।

আমরা ভয় ভুলে গেছি তখন। রবার বুলেট পরোয়া না করে এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু টিয়ারগ্যাস; এই বস্তু টিকতে দেয় না আমাদের। এই ছাদ থেকে এসে পড়ে, অই ছাদ থেকে পড়ে। আমরা অপেক্ষা করি— এই গ্যাস শেষ হবার। শেষ তো হবেই। কিন্তু শেষ হয় না। ভাবতে ভাবতেই একটা টিয়ারগ্যাস এসে পড়ে আমাদের মাঝে। আমার পায়ের কাছে৷ পুলিশ দূর থেকে নিক্ষেপ করলে এতদূর আসবে না— আমরা জানতাম। ছাদ থেকে ফেলা হয়েছে। কিছু না-ভেবেই তুলে নিলাম হাতে, ছুঁড়ে মারলাম পুলিশবাহিনীর দিকে। জয়োল্লাস শুরু হলো। প্রত্যেকেই আমরা এই কাজ শুরু করে দিলাম। সুযোগ হলেই পাল্টা ছুঁড়ে মারার নেশা পেয়ে বসলো আমাদের।

দুপুরে, ক্রিসেন্টের সামনেই আমরা— স্লোগান দিচ্ছি। কিংবা জিরিয়ে নিচ্ছি। কেউ একজন জুস দিচ্ছেন, সে আমাদের শাশ্বত বোন। কেউ একজন দিচ্ছেন বিস্কুট, তিনি আমাদেরই কারও পিতা। প্রতিটি বাসা থেকে খুলে দেওয়া হয়েছে পানির লাইন। দোকানগুলো হয়ে ওঠেছে আমাদের আশ্রয়। সাধারণ জনগণ আমাদের গ্রহণ করে নিচ্ছে এভাবেই। ততক্ষণে হাসপাতালে ভয়াবহ অবস্থা। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। রাস্তা ডিভাইডারে বসে কেউ কেউ আমরা কেক খাচ্ছি, কেউ বিস্কুট। এরই মাঝে একজন খিচুড়ি নিয়ে এলেন আন্দোলনকারীদের জন্য। তার কণ্ঠে মায়া, বাবারা আমার যা সাধ্য ছিলো এনেছি— তোমরা খাও, নাও, লজ্জা কোরো না। এক প্যাকেট তিনজন ভাগ করে খেলাম। আমার মনে হতে লাগলো মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের কথা। এমন চমৎকার খিচুড়ি কখনো খেয়েছি কি? 

আমরা আবারও এগিয়ে যেতে চাই। পুলিশ ব্যারিকেড ভেঙে ফেলি। এবার তারা পিছিয়ে যাচ্ছে, থানার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা থানার কাছাকাছি চলে আসি। তারা সমঝোতায় আসতে চায়। আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে বলেন এবং তারা ফেরত যাবেন বলে জানান। আমরা প্রশ্ন ছুড়ে দিই তাদের দিকে। তবে এত রক্ত কেন? তারা উত্তর দেয় না। তর্ক হয়, বিতর্ক হয়। এরইমাঝে অকস্মাৎ শুরু হয় গুলি। টিয়ারগ্যাস। আমরা আবার ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ছোটাছুটি আরম্ভ করি।

আমরা যোগাযোগ করতে পারি না কারও সাথে। মোবাইল নেটওয়ার্ক শূন্য। আমরা জানিনা এই শহরের অন্যকোনো স্থানের খবর। একবার সুজানার সাথে কথা হলো। ফারাহর সাথে হলো। আরও কেউ কেউ। রনী ভাইকে কল দিলাম। পরিস্থিতি জানালাম।


চলছে। টিয়ারগ্যাস। গুলি। রক্ত। ছোটাছুটি।

পায়ে কিসের আঘাত লাগলো? ইট না অন্যকিছু?

বসে যাই রাস্তায়। পা দেখতে থাকি। পাশ থেকে প্রশ্ন আসে, বেশি লাগছে? না... বলার আগেই দেখি গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ছে আমার পেছনে থাকা ছেলেটা। হাতে পানির ও বিস্কুটের প্যাকেট কি! কিছুক্ষণ আগেই বিতরণ করলো যেসব।

কারো পানি লাগবে, পানি?

ওর বন্ধুরা ছুটে আসে।

ওকে নিয়ে যায় ক্রিসেন্টের দিকে।

আমি সামারাকে বলি, গুলিটা কি আমার লাগতো? আমার গুলিটা কি ছেলেটি খেলো? অবস্থা তো মারাত্মক মনে হলো। বাঁচবে তো?

ছেলেটির খবর জানি না আর।

বন্ধ হয়ে যায় নেটওয়ার্ক।

প্রায় দশদিন পর ফেসবুকে ফিরে দেখি, একটি ছেলে।

পানি বিলিয়ে যাচ্ছে।

কারো পানি লাগবে, পানি?

চেহারা চিনতে পারি আমি।

এই ছেলেকে দেখেছি সেদিন। রাস্তায়, আমার পাশে।গুলিবিদ্ধ লুটিয়ে পড়লো যে। সে আর নেই। নিজের নামের মতোই যাবতীয় মুগ্ধতা নিয়ে সে চলে গেলো অস্তাচলে।

মুক্তির মন্দির সোপান তলে...

আমি সামারাকে নক দিই। সেই ছেলে। যার নাম মুগ্ধ। 

কথায় না বড় হয়ে...

-রাহাত রাব্বানী, কবি


#Tales_Of_July

Post a Comment

Previous Post Next Post