একটা অমানবিক ছবির গল্প..

 


ছেলেটা সত্যি বাঁচতে চাইছিল
কিংবা পারিনি বাঁচাতে..

২০১৫ সালে বিএনপি জামাতের জ্বালাও পোড়াও দেখেছি।  চোখের সামনে দেখেছি কিভাবে জীবিত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।  অনেকগুলো নৃশংসতা দেখেছি। ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা থেকে শুরু করে চোখের সামনে শত শত জীবিত মানুষকে লাশ হতে দেখছি। 

কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই পেশাগত দায়িত্বে ভীষণ রকমের একটিভ ছিলাম। ঘুম নেই, খাওয়া নেই, নিজের কথা চিন্তা করার সময় পাইনি, অমানবিক নিষ্ঠুর হয়েছিলাম নিজের প্রতি। চোখের সামনে পাখির মত মানুষকে গুলি করে হত্যা করতে দেখেছি আন্দোলন চলমান সময়ে। এতোটাই মানসিক ট্রমার মধ্যে ছিলাম যে রাতে ঘুমটাও ঠিকঠাক হতো না। 

আরো বেশি ভয় পেয়েছিলাম কিছু মানুষ না বুঝেই সাংবাদিক পেটানো শুরু করলো। একদিকে আন্দোলনকারীরা হামলা করছে অন্য দিকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাকর্মীরা, ক্ষমতাশীনরাও আমাদের খুঁজে খুঁজে পিটাতে শুরু করলো। যেখানে যাই সেখানেই হামলার শিকার হচ্ছিলাম। 

খুব বেশি সতর্কতার সাথে নিজের জীবন রক্ষা করে কাজটাই করার চেষ্টা করছিলাম। ছয়দিনের মত বাসার বাইরে বাইরে পালিয়ে ছিলাম। এক জামা কাপড় পড়ে কাটিয়ে দিলাম ওই কয়টা দিন। রাতে টিশার্ট ধুয়ে সকালে পরে বের হতাম। 

যাই হোক ৪ আগস্ট সকালে বেরিয়ে গেলাম, পরিস্থিতি খুবই ভয়ঙ্কর। এক ঘন্টার মত দাঁড়িয়ে আছি বাংলা মোটর গলির ভিতরে, কারণ ছবি তুলতে গেলেই নিজের গায়ে গুলি লাগার অপার সম্ভাবনা। সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছে ভাই ওদিকে আওয়ামী লীগের লোকজন গুলি করছে আমাদের উপর আপনারা সামনে যান ছবি তুলে প্রকাশ করুন। 

নিজেও খানিকটা বোঝার চেষ্টা করলাম আসলেই কে গুলি করছে! তারপর একটু একটু করে সামনে গিয়ে দেখি পুলিশের পাশাপাশি গুলি করছে ছাত্রলীগ যুবলীগ সহ আওয়ামীলীগের সকল সন্ত্রাসী বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপরে। বৃষ্টি মত গুলি বর্ষণ হচ্ছে। কী যে ভয়াবহ পরিস্থিতি! 

আমরা  চার-পাঁচজন কারওয়ান বাজারের অলিগলির মধ্য দিয়ে ফার্মগেট গেলাম। সাংবাদিকরা ফার্মগেট যাওয়ার পর দেখলাম একদল পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনেক দুরে পুলিশের গুলিও চলছে না এইটুকু বুঝতে পারছি তারা কিছু একটা ঘটাচ্ছে। আমি পুলিশের ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতে চাইলাম হঠাৎ তিন-চারজন পুলিশ আমার সামনে এসে দাড়িয়ে বললো, ওইখানে যাওয়া যাবে না ছাত্ররা গুলি করছেন ওপাশ থেকে আপনি গেলে আপনার গায়ে গুলি লাগবে। 

পুলিশের কথা শুনে তাকে বললাম, আপনি আমাকে কোন ভাবে বাঁধা দিতে পারেন না। সেই অধিকার আপনাদের নেই আমি আমার পেশাগত দায়িত্ব পালন করবো আপনি আপনার পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন। আপনাদের আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।

কথাটা শেষ না হতেই দেখলাম পাশ থেকে একটা রিকশা ওই ভীড়ের দিকে যাচ্ছে  ঠিক তখনই আমার আরো সন্দেহ হলো কেনো না করছে, কেনো যেতে দিচ্ছে না। হঠাৎ খেয়াল করে দেখলাম চার হাতপা ধরে রক্তাক্ত অবস্থায় নীথর দেহ একজন মানুষকে রিকশায় উঠিয়ে দিচ্ছে। রিকশার পা-দানিতর নিচে কোন রকম ফেলে রেখে দ্রুত নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটার কপালে জাতীয় পতাকা বাঁধা, তখনও বেঁচে আছে। ছেলেটার নিভু নিভু অসহায় চোখ আমার ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সাথে সাথে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে শুরু করি। পুলিশ বার বার বাঁধা দিচ্ছে কিন্তু আমিতো কথা শোনার মানুষ না। রিকশাটা অল-রাজি হাসপাতালের নিয়ে গেলো। হাসপাতালের গেটের কাছে যাওয়ার সাথে সাথে ৪০-৫০ জন আওয়ামী লীগের নেতারা রিকশা ঘিরে ধরল। ছেলেটাকে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে দিল না। 

আমি তখনও ছবি তুলে যাচ্ছি। হঠাৎ ওদের মধ্যে একজন আমাকে খেয়াল করলো। সাথে সাথে ক্যামেরা নামিয়ে চুপচাপ অন্য দিকে হাঁটা শুরু করলাম, ঠিক তখনই আমাকে চার-পাঁচ জন ডাকলো দিলো। জিগ্যেস করলো, "তুই ছবি তুলেছিস?" আমি ভয়ে বললাম ভাই ছবি তুলি নাই পুলিশের সাথে দাড়িয়ে ছিলাম আমরা। 

তখন কে কার কথা শোনে, ওরা আমার ক্যামেরা চেক করলো। আমি একটু বুদ্ধি করে আগের ছবি দেখিয়ে বললাম, ভাই দেখেন আপনাদের ছবি তুলি নাই। ঠিক পাশে আমার আরেকজন সহকর্মীকে রড দিয়ে পায়ে বাড়ি মারলো। সাথে সাথে ছেলেটা চিৎকার দিয়ে উঠলো আরেকজন তার অন্ডকোষে লাথি মারলো। ছেলেটা ব্যাথায় বসে পড়লো রাস্তায়। ওদের হাত-পা ধরে কোন রকম আমরা চারজন মিলে সহকর্মীকে টেনে নিয়ে দৌড় দিলাম। কোন রকম অফিসের কাছে নিয়ে গেলাম। আমার সহকর্মী  অফিসের সিড়ির নিচে শুয়ে পড়লো ব্যাথায়। 

ছবিটি পত্রিকায় ছাপিয়ে দিলাম কোন ধরনের ভয় ছাড়া। রাত ১২ টার পর ছবিটা সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। সোশ্যাল মিডিয়াতে ছবি দেখে পরিবারের লোকজন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে লাশ খুঁজে পায়। 

ঘটনার দুইদিন পর তার বাবা আমার সাথে যোগাযোগ করে।  জানতে চায় তার ছেলেটা তখনও বেঁচে ছিলো কি না। ডাক্তার বলেছে ছেলেটার বুক ভেদ করে পিছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। আমি তখন তাকে বলতে পারিনি ''না আপনার ছেলে তখনও বেঁচে ছিলো!'' এই সাহস আমার হয়নি। ভয়ংকর এক অপরাধ বোধ আমাকে তাড়া করে। আমি তার বাবাকে মিথ্যা বলছিলাম আপনার ছেলে ছেলে বেঁচে ছিলো কি না তা খেয়াল করিনি। 

ভয়ংকর এক মানসিক যন্ত্রণা আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।  আমি এখনও দেখতে পাই ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো আমার কাছে সাহায্য চাইছিলো। কিন্তু আমি তখন বুঝতে পারিনি ছেলেটা সত্যি বাঁচতে চাইছিল। কিংবা পারিনি বাঁচাতে। এইরকম আরো শতশত অপরাধবোধের গল্প থাকে একেকটা সহিংসতার ছবির পিছনে। সেসব নিয়ে আমি এবং আমরা বেঁচে থাকি মৃত্যুর কাছাকাছি। না পারি প্রাণভরে আনন্দে বাঁচতে আর না পারি বাঁচতে চাওয়া মানুষ গুলোকে বাঁচাতে। ইতিহাসে লেখা থাকেনা সেসব পেছনের গল্প। তাই বলতে এলাম আজ। যন্ত্রণা হচ্ছে খুব বুকের ভেতর। পৃথিবীটা মানুষের হোক, ক্ষোভ, লোভ আর হিংসা মুক্ত একটা দেশ তৈরী হোক। সবকিছুর উর্ধ্বে মানুষ আগে মানবিক হোক। নৈতিকতার সংস্কার হোক। এই আশায় আবারো বাঁধি বুক।

- জীবন আহমেদ; ফটোসাংবাদিক, মানবজমিন।


#Tales_Of_July

Post a Comment

Previous Post Next Post