আমি তো মানুষ, মানুষ মরলে মানুষেরই তো কষ্ট লাগে

 

মোহাম্মদ ফয়েজ। পেশায় একজন ওয়ার্কশপ মিস্ত্রি। সাত সদস্যের পরিবারের একমাত্র অর্থ উপার্জনকারী। যার উপার্জনে চলতো পুরো পরিবারের ভরণপোষণ। বিগত পাঁচ মাস ধরে বন্ধ তার উপার্জন। পরিবারে তাই নেমে এসেছে কালো মেঘের ছায়া। একটি বুলেটে বদলে গিয়েছে পুরো পরিবারের দৃশ্য।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শটগানের গুলি লেগে ফয়েজ হারিয়েছেন তার ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি। ফলে ওই চোখে এখন দেখতে পান না তিনি। চিকিৎসার অভাবে হারাতে বসেছেন দুই চোখের দৃষ্টিশক্তি। 

চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, গুলিতে তার ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। জরুরি ভিত্তিতে অন্য চোখের চিকিৎসার প্রয়োজন। তবে চিকিৎসার খরচ চালানোর আর্থিক সামর্থ্য ফয়েজের পরিবারের নেই। চিটাগাং রোডের মুক্তিনগর এলাকায় দুই কক্ষের একটি টিনশেড ভাড়া বাড়িতে ফয়েজ তার পরিবারসহ বসবাস করেন। 

ভোলা জেলার বড়নদী উপজেলার হাবিবুল্লাহ (৬৫) ও জহুরা বেগমের (৫০) সাত সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফয়েজ (৩৫)। ফয়েজের ৪ বোন বিবাহিত। তার অন্য দুই ভাই হাবিব (১৪) ও আব্দুর রহমান (৮)। ফয়েজ অসুস্থ হওয়ার পর থেকে পড়াশোনা ছেড়ে হাবিব যুক্ত হয়েছেন তার ভাইয়ের কর্মক্ষেত্রে। একজনের উপার্জনে নির্ভরশীল তাদের বৃদ্ধ বাবা-মা সহ সাতজনের পরিবার। 

দৃষ্টিশক্তি হারানোর নিজের জীবনের সেই ভয়াবহ দিনের কথা মনে করে ফয়েজ বলেন, ‘আমি তো ছাত্র না, ছাত্রদের আন্দোলনে যাওয়ার কথা আমার ছিলো না। কিন্তু আমি তো মানুষ। মানুষ মরলে তো মানুষের কষ্ট লাগে। সেই কষ্টের কারণেই আন্দোলনে গিয়েছিলাম।’

তিনি বলেন, আমি ২০ জুলাই বিকালের কথা বলছি। ওইদিন সকাল থেকেই বার বার গুলির আওয়াজ পাইতেছিলাম। দুপুরের পর বাসা থেকে বের হই।

চিটাগাংরোড ব্রিজের ওইদিকে (ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক) লাশের ওপর লাশ পড়েছিল। পুলিশ লাশ নিয়ে যাইতেছিল। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাস্তায় আমি সহ কয়েকজন লাশ সরাই। লাশ সরাই দেইখা, আমাদের ওপরেও ছররা গুলি ছোঁড়ে। তারপর আমরা ইটা কঙ্কর দিয়ে পুলিশরে ঢিলা দিয়া দূরে সরায়ে দেই।

আমরা ভাবছিলাম পুলিশ চলে গেছে। এজন্য রাস্তা থেকে লাশ নিয়ে আসতে যাই। আমরা আর খেয়াল করি নাই, পুলিশ ব্রিজের (ফুটওভার ব্রিজ) ওপর উঠে আমার দিকে গুলি ছোঁড়ে। গুলি আমার নাকের ভিতর দিয়ে ঢুকে ডান চোখ দিয়ে বের হয়। গুলিতে আমার ডান চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। ওই চোখে আমি দেখি না। বাম চোখেও সমস্যা হচ্ছে। ঝাপসা দেখি। ডাক্তার বলছে আরেকটা অপারেশন লাগবে।’ 

আহত ফয়েজ আরো বলেন, যেখানে সংসার চালানোর টাকা নাই, অপারেশনের খরচ তো অনেক, তা কোথা থেকে আসবে? অপারেশনটা সরকারি হাসপাতালে ফ্রি করালেও ঔষধ সহ অনেক খরচ হয়। আমার ছোট ভাই পড়া ছাইড়া ওয়ার্কশপে যোগ দিছে। সংসার চালাইতে তো টাকা লাগে। কম খাইছি কিন্তু না খেয়ে থাকি নাই। আমাগো ঘরে কখনো এমনটা হয়নি। ডাল-ভাত হলেও তিনবেলা খাইছি। 'জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন' থেকে এক লাখ টাকা পেয়েছিলাম। যেটা আমার চিকিৎসা বাবদ খরচ হয়ে গেছে। 

এদিকে স্বামী অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তাদের একমাত্র শিশু সন্তান তোয়ামনি (২০ মাস) কে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন সাজেদা আক্তার। 

তিনি বলেন, আমার স্বামী কোন ছাত্র না। তারপরও আন্দোলনে গিয়েছিল মানুষের টানে। কিন্তু আজ আমাদের পরিবারটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমার স্বামী পাঁচ মাস ধরে কাজ করতে পারছে না। আমার ছোট একটা বাচ্চা আছে, বাচ্চা রাইখা কোথাও কাজ শুরু করতে পারতেছি না। আমার দেবরের বেতনে কোন রকমে সংসার চলতেছে। অনেক অভাবে আছে আমাগো পরিবার।

স্ত্রীর কথা শুনে কান্নাজড়িত কন্ঠে ফয়েজ বলেন, আমারে ডাক্তার কোন ভারি কাজ করতে না করছে। কিভাবে আমার জীবন চলব জানি না। আমার ছোট একটা মেয়ে আছে। যে মেয়ে আমার বাড়িতে ঢুকলে আব্বু আব্বু বলে দৌড়ে আসত, এখন ডরায়। আমার চোখটা দেখলে মাইয়াটা ভয় পায়, কাছে আসে না। আবার বলে, কাইট্টা গেছে। 

আর্থিক সংকটে মানসিক ভাবেও দূর্বল হয়ে পড়েছেন ফয়েজ। চাচ্ছেন সরকারি সহায়তা। তিনি বলেন, ‘আমার অনুরোধ, সুস্থ হয়ে যেন আগের মতো কাজ করতে পারি সেই ব্যবস্থাডা যাতে সরকার করে দেয়।’

তথ্যসূত্র: বাসস

#Tales_of_July

Post a Comment

Previous Post Next Post