ব্রাশ করতে করতে দ্রুত পায়ে কলপাড়ের দিকে যায় সুজন। আজকেও দেরি হয়ে গেছে। সকাল সকাল সিরিয়াল ধরতে না পারলে লুঙ্গিতেই সেরে ফেলতে হবে কাজবাজ। ভোরে উঠতে পারলে ওইমুখো হওয়ার কোনো প্রয়োজনই পড়তো না। রেললাইনের পাশে গিয়ে দেদারসে কাজ সেরে ফেলা যেত। ভোরে অবশ্য কলপাড়ও নির্ঝঞ্ঝাট থাকে। সূর্যটা দেখা গেলেই শুরু হয় হাউকাউ। গার্মেন্টসের হাজিরা ধরার জন্য পারলে সূর্য এর আগেই ওঠে বস্তির মেয়েছেলেরা। কলপাড় নামক পরিচিত জায়গাটি মূলত সিটি বাজার বস্তির ল্যান্টিনসংলগ্ন এলাকা। প্রায় অর্ধশতাধিক রুমের এই বস্তির বাসিন্দা ২০০ জন হবেই। সবার জন্য বরাদ্দ তিনটি টয়লেট ও একটি টিউবয়েল। তাই ঢাকা সিটি থেকে ষাট কিলো দূরের এ বস্তির সবাই দআর্লি রাইজারদ।
প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার ঝামেলা না থাকলে সুজন বেলা ১২টা অব্দি ঘুমাতে পারতো। গার্মেন্টসের মেয়েছেলের মতোন সুজনের হাজিরা ধরার প্যারা নেই। কোনো মহাজনের রক্তচক্ষুরও ভয় নেই। এ বস্তিতে সুজনের মতো আরো আট-দশজন কিশোর আছে। রেললাইনের ওইপাশে আছে আরো-দশ বারোজন। বেলা ১২টার এ ছোট গ্রুপটার অঘোষিত আড্ডা শুরু হয় রেলপাটির ওপরে। চেহারা-সুরত আর পোশাক দেখে অনেকেই সুজনদের এ গ্রুপকে ছিনতাইকারী মনে করে। ভদ্রলোকরা রেলপাটির ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ওদের দেখলে প্যান্টের ওপর থেকে মানিব্যাগ চেপে রাখে, হাতে মোবাইল রাখলে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে। এসব দেখে সুজনরা মজা নেয়। আদতে ওরা ছিনতাইকারী না। নেশাপানির বাতিকও নেই। একদম যে নেই সে কথা আবার বলা মুশকিল। এ এলাকার বাতাসে যতটুকু আছে ততটুকুই আরকি।
সুজন বাজারের এক ওয়ার্কশপে ম্যাকানিকের কাজ করতো। সুজনদের বস্তির সাইদুল কাজ করতো হোটেলে, রনি বিক্রি করতো ঝালমুড়ি, পিন্টুর ছিল বাসে বাসে উঠে বাচ্চাদের বই-বিক্রি করার কাজ। এভাবে সবাই কোনো না কোনো কাজ করতো। সিটি বাজারের একচ্ছত্র মালিক খোকন ভাই তাদের সবার জীবন পাল্টে দিয়েছে। সে অন্য আলাপ। আপাতত সুজনের কলপাড় গমনের দিকেই তাকানো যাক।
রুম থেকে বের হয়ে চিপা গলি দিয়ে কলপাড়ের দিকে হাঁটার সময় সুজনের মনে হয় কিছু একটা ঠিক নেই। কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। কলপাড়ের কাছাকাছি আসতেই বড়সড় ধাক্কা খায় আর বুঝতে পারে কেন অস্বস্তি লাগছিল। প্রতিদিনের মতো টিউবয়েলের ক্যাচ ক্যাচ শব্দ কানে আসছিল না। পুরো কলপাড় খালি। টয়লেটের দরজাও সটান করে খোলা। ভেতরের হলুদাভ ময়লা দেখা যাচ্ছে। কোনো লোক নেই কেন! গেল কই সবাই? বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা শুরু হয় সুজনের। কিছু সময়ের জন্য মনে হয় স্বপ্ন দেখছে সে। এদিক-ওদিক তাকায় সুজন। একটা ইঁদুরের সঙ্গে চোখাচুখি হয়। ইঁদুরটা ফুড়ুত করে দৌড় দেয়। সুজন কলপাড়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ব্রাশ করে, অন্য কেউ যদি আসে সেই আশায়। কিন্তু কেউই আসে না। ব্রাশ করতে করতে দাঁতের নিচের নরম চামড়া ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হলে কুলি করে সুজন। কুলি করে পানি ফেলার সময় দেখে পানির রং লাল। ব্রাশের পর এমন একটু রক্ত বের হয় মুখ থেকে সুজনের। আজকে বেশি সময় ধরে ব্রাশ করার জন্য রক্তের পরিমাণ আরো বাড়ে। এরপর ধীরপায়ে টয়লেটের দিকে যায় সুজন। প্যানের ওপর বসার পর মনে হয় চাপ লঘু হয়ে গেছে। সময় ক্ষেপণ করার জন্য কিছুক্ষণ টয়লেটে কারণ ছাড়াই কাটায় সুজন। এত দীর্ঘ সময় এর আগে কখনো টয়লেটে থাকতে পারেনি সে।
টয়লেট থেকে বের হয়ে কলে এসে মুখে পানির ঝামটা দিয়ে ঘোর কাটাতে চেষ্টা করে সুজন। ঘুমের ঘোর কেটে যাওয়ার পর আরো কিছুক্ষণ কলপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে, অন্য কেউ আসবে সেই আশায়। কিন্তু কেউ আসে না। হলো কী সবার?
সুজনের কপালের ভাঁজ বাড়তে থাকে।
‘কিরে সুজইন্যা, করোস কী?’ সুজনের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে পারুল।
পারুলকে দেখে পুলকিত অনুভব করে সুজন। যাক, একজনকে পাওয়া গেল। এত সকালে কলপাড়ে একটা মেয়েকে একা পেয়েও কেমন যেন শরীর মোড়ায় সুজনের। তবে সেটাকে পাত্তা না দিয়ে কলপাড় মানবশূন্য হওয়ার রহস্য উদঘাটনের দিকেই মনোযোগ দেয়।
‘পারুল আপা, তোমগো আজকে ডিউটি নাই? কলপাড় খালি ক্যা?’
‘তুই দেহি কিছুই জানোস না।’ চোখ ছোট করে বলে পারুল।
‘হইছেডা কী? আমারে খুইলা কও।’ কৌতূহল আরো বাড়ে সুজনের।
‘এইখানে খুলতে পারুম না। লাগলে রুমে আহিস।’ পারুলের মুখে বাঁকা হাসি। সুজনের বুকের ভেতর ঢিবঢিব করে।
‘মশকরা কইরো না তো। কও না কী হইছে। আমি
কিছুই জানি না।’
‘দ্যাশে যে গ্যানজাম লাগছে খবর রাখোস? নাকি রেলপাডির ওইপাশের কোনো খবরই তোগো কোনো আহে না?’ এবার একটু কঠিন হয় পারুলে মুখ। মুখের বাঁকা হাসি মিলিয়ে যায়। থতমত খায় সুজন।
‘কিসের গ্যানজাম আপা?’
‘ঢাকায় আন্দোলন হইতাছে কিয়ের যেন। কাইলকা সন্ধ্যায় আমগো বাজারেও হইছে। পুলিশ গুলি কইরা চাইর জনরে মাইরা ফেলছে। সব গার্মেন্টস বন্ধ। কারফু দিসে সরকার।’ তরতর করে বলে পারুল।
এত তথ্য একসঙ্গে শুনে অসাড় হয়ে যায়। দেশে ছোটখাটো একটা ঝামেলা শুরু হয়েছে, সেটা সে জানতো। তবে খোকন ভাই বলেছিল এসব কিছুই না। কয়েক দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। নির্বাচন বন্ধ করতে না পেরে এখন ছাত্রদের মাঠে নামিয়েছে বিরোধী দল। সুজন এসব বিরোধী দলটল কিছু বুঝে না। নির্বাচনের আগে খোকন ভাইয়ের সঙ্গে তার পরিচয় রনির মাধ্যমে। খোকন ভাই সিটি বাজার যুবলীগের নেতা, বাজারে চাঁদাটাদা তোলে। দুটো রিকশার গ্যারেজ আছে, এলাকার ডিশ আর ইন্টারনেটের ব্যবসাও তার। এসবের বাইরেও আরেকটা পরিচয়ও আছে অবশ্য। খোকন ভাই এমপি সাহেবের খাস লোক। ভোটের আগে যখন আন্দোলন হচ্ছিল দেশে তখন এমপি সাহেব খোকন ভাইকে নির্দেশ দেয় কিছু ছেলেপেলে যোগাড় করতে। খোকন ভাইয়ের ডিশের ভাইয়েল ডিশের দোকানের সামনে ঝালমুড়ি বিক্রি করতো রনি। সেখান থেকেই রনি দায়িত্ব পায় লোক গোছানোর। ভোটের আগে সুজনদের কাজ ছিল মিছিল-মিটিং এ যাওয়া। অন্য দলের মিটিং হলে সেখানে ধাওয়া দেয়া। আর ইলেকশনের সময় পিকাপে বক্স বাজিয়ে এলাকায় রাউন্ড দেয়া। কাজ কম, টাকা বেশি। ভোট শেষ হওয়ার পর সুজনদের কেউ আর আগের কাজে ফেরত যায় নাই। খোকন ভাই প্রতি মাসে টাকা দেয়। শর্ত একটাই, নেতা ডাকলে হাজির থাকতে হবে।
রুমে এসে একটা শার্ট গায় দিয়েই রেলপাটির উদ্দেশ্যে বের হয় সুজন। এতবড় গ্যানজাম হয়েছে অথচ সে জানেই না। কাল বিকেলে পিন্টুর জোরাজুরিতে একটু সিদ্ধি টেনেছিল। কোনোরকম পা টেনে রুমে ফিরেছে। এরপরেই বিছানায় কাত। সন্ধ্যায় যে এতবড় ঘটনা ঘটেছে, সেটা আর জানতে পারেনি সে।
রেল পাটির ওপর ছেলেপেলে অলরেডি চলে এসেছে। মাত্র ৭টা বাজে। এত সকালে কারো আসার কথা। সুজনকে দেখে এগিয়ে আসে পিন্টু।
‘কিরে মামা, খবর শুনছোছ?’ পিন্টু প্রশ্ন করে।
সুজন কিছুই বুঝতে পারে না। কোন খবরের কথা বলে পিন্টু। সদ্য পাওয়া খবরটাই তাই ঝালাই করে নিতে চায়।
‘বাজারে পুলিশ গুলি করছে শুনলাম। আর কি হইছে?’
‘খোকন ভাই ডাকছে। গ্যানজামে নামা লাগবো।’
‘গোলাগুলির মইধ্যে কেমনে যামু?’
‘টেকা বাড়ায়া দিবো কইছে।’
‘কত কইরা দিবো?’
‘জনে পাঁচশো কইরা বাড়াইবো।’
‘তাহলে চল।’
সুজনের সম্মতি দেখে পিন্টু একটু অপ্রতিভ হয়ে যায়।
‘মামা, তুই আসলেই জানোস না কী হইছে?’
‘বাজারে গ্যানজাম হইছে। পুলিশ গুলি করছে। আর কী?’
‘আমগো রনিরে মাইরা ফেলছে পুলিশ।’
‘রনি...’
সুজন ধপাস করে রেলপাটির ওপর বসে পড়ে। পাশ থেকে কথা বলতে থাকে পিন্টু।
‘রনি ভার্সিটির ভাইগো লগে স্লোগান দিতাছিল। এক ভাইয়ে ওর মাথায় পতাকা বাইন্ধা দিছিল। পুলিশ যখন গুলি করছে তখন রনি সামনে আগায়া গেছে দুই হাত মেইলা দিয়া।’
‘কেন আগায়ছে!!’ হতবিহ্ববল সুজন প্রশ্ন করে।
‘রংপুরের এক ভাই দুই হাত মেইলা বুকে গুলি নিছিল কাইলকা দুপুরে। রনি ওইটা দেইখা সাহস পাইছে।’
সুজনের কিছু মাথায় আসে না। কিছুই ভাবতে ইচ্ছা করে না। দূর থেকে খোকন ভাইকে এগিয়ে আসতে দেখে। খোকনকে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে যায়।
‘কিরে মাঙ্গের নাতিরা। তগোরে কী পালকিতে কইরা নিতে হইবো? কত আগে যাইতে কইছি? কলেজের পোলাপান পতাকা বাইন্ধা বাজারে মিছিল করতাছে, আর তোরা এইখানে বইসা আঙুল চুষোছ?’
খোকনের কথা শেষ হয় কিন্তু রাগ শেষ হয় না। পিন্টুর গালে কষে একটা থাপ্পড় লাগায় সে। সবাই ভয়ে ও শোকে চুপ করে থাকে। মৌনতা ভাঙে সুজন।
‘আমগো রেট বাড়াইতে হইবো। নাহলে যামু না।’ গলা উঁচু করে বলে সুজন।
‘কইছি তো ৫০০ কইরা বাড়ামু। আরো কত চাস? কত লাগব তোগো?’
‘যত রেট হইলে রনির জীবন ফিরায়া আনা যাইব।’ দ্ব্যর্থ কণ্ঠে বলে সুজন। খোকন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
গল্পের জন্মকথা : জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছে সমাজের নানা স্তরের মানুষ। কেউ কেউ অংশগ্রহণ করেছেন একদম ভিন্নভাবে। পক্ষত্যাগের এ গল্প আমি শুনেছি আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে। জুলাইয়ের গল্পে সুজনদেরও স্থান হোক।
Post a Comment