"মাথার পেছন দিয়ে বুলেট ঢুকে বেরিয়ে যায় চোখ দিয়ে"

ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বাংলাদেশকে কার্যত কারাগারে পরিণত করা হয়েছিল, আর সে কারাগার ভাঙতে প্রাণপণ লড়াই করেছেন যারা তাদের একজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র ইকরামুল হক সাজিদ। ৪ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে ১৪ আগস্ট প্রাণত্যাগ করেন তিনি। তার মা সেদিন সাজিদকে বাইরে যেতে মানা করেছিলেন। কিন্তু মায়ের বাধা সাজিদকে আটকাতে পারেনি রাজপথে যাওয়া থেকে।

টিউশন করে পড়াশোনার খরচ চালানোর পাশাপাশি টাকা জমিয়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে অসহায়দের সাহায্য করতেন। মসজিদের মুয়াজ্জিনকে বেতনও দিতেন। তা এখন থমকে গেল। তার কয়েকজন বন্ধু গত ২৬ ডিসেম্বর সাজিদের কবর জিয়ারত করতে গেলে সাজিদের মাকে কবরের ধারে বসে অঝোরে কাঁদতে দেখেন। তিনি আবদার রাখেন যেন সাজিদের বন্ধুরা তার সঙ্গে বারবার দেখা করতে আসেন। এতে মনে হবে সাজিদের বন্ধুরাই বেঁচে যাওয়া সাজিদ।

বন্ধুদের নিয়ে সাজিদ নিয়মিত আন্দোলনে যোগ দিতেন। ৪ আগস্ট দুপুরে সাজিদ কাফরুলের বাসা থেকে বের হন মিরপুর-১০-এর উদ্দেশে। মা নিষেধ করেছিলেন সেদিন আন্দোলনে যেতে। কিন্তু কোনো বাধাই মানেননি তিনি। গুলি লাগার আগ মুহূর্তে বন্ধুদের সঙ্গে সেলফি তুলেছিলেন। সেই ছবিটিও সামাজিকমাধ্যমে ঘুরপাক খাচ্ছিল।

বিকাল সাড়ে ৫টায় উল্টো দিক থেকে আসা একটি গুলি সাজিদের মাথার পেছন দিক দিয়ে ভেদ করে ডান চোখ দিয়ে বের হয়। যেদিক থেকে গুলি আসে, সেদিকটায় পুলিশ, বিজিবি, হেলমেট পরিহিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীরা অবস্থান করছিল। প্রত্যক্ষদর্শী দিপু ও তরিকুল আমার দেশকে জানান, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আমরা প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না যে ওটা সাজিদ। শার্ট দেখে নিশ্চিত হই এটা সাজিদ। পরে বাকি বন্ধুদের ফোন দিতে থাকি। এরপর রিকশায় করে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রেফার করা হয় ঢাকার সিএমএইচে।

আরেক বন্ধু তরিকুল আমার দেশকে জানান, সেদিন সাজিদের গরম মগজ আর রক্তে আমার হাত ও বুক ভেসে গিয়েছিল। বন্ধুদের দাবি, সাজিদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কিছু করা হোক। পরিবারের হাতে একটা ফান্ড তুলে দেওয়া হোক। নতুন একাডেমিক ভবনের নাম ‘শহীদ সাজিদ ভবন’ করা হোক।

সাজিদের বিভাগের আরেক বন্ধু রনি আমার দেশকে বলেন, গত ২৭ ও ৩০ জুন সাজিদের জীবনে শেষ দুটি মিডটার্ম আমি আর সাজিদ একই বেঞ্চে বসে দিই। কিন্তু সে এখন আর আমাদের মাঝে নেই। গত ২২ সেপ্টেম্বর সাজিদের এমবিএর প্রথম সেমিস্টারের পরীক্ষা ছিল । পরীক্ষার হলে একটি আসন ফাঁকা রাখা হয়েছিল তার স্মরণে। তারা জাতীয় পতাকায় ঢাকা বেঞ্চটিতে রেখে দেন একগুচ্ছ তাজা ফুল।

সাজিদের ডিপার্টমেন্টের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শামসুন্নাহার আমার দেশকে জানান, সাজিদ এমবিএর প্রথম সেমিস্টারের পরীক্ষাটি দিতে পারেনি আন্দোলনে শহীদ হয়ে যাওয়ায়। সে বিবিএতে প্রথম শ্রেণির রেজাল্ট করে। সাজিদ ২০২২ সালে বিবিএ ৩য় বর্ষে পড়ার সময় জুলাই সেশনে সিএমএ প্রফেশনাল ডিগ্রিতে ভর্তি হয়।

এই কোর্সের ৬০০ নম্বরের পরীক্ষাও সম্পন্ন করেছিল সে। ডিপার্টমেন্টের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. শফিকুল ইসলাম আমার দেশকে জানান, সাজিদ যেদিন গুলিবিদ্ধ হলো, সেদিন থেকে ওর দাফনের দিন পর্যন্ত আমি ওর খোঁজ-খবর রেখেছি। সাজিদের বের হওয়া মগজগুলো যখন ডাক্তার আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সংরক্ষণ করার জন্য সাভারে যেতে বলল, তখনকার সেই দৃশ্য বলে বোঝাতে পারব না। সাজিদের চিকিৎসার জন্য আমরা দেশে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি ওর বন্ধুদের নিয়ে।

সাজিদের বন্ধুরা আমার দেশকে জানান, তার স্বপ্ন ছিল ওর এলাকার মসজিদটি আরও বড় ও উন্নত করবে। সাজিদের জানাজার দিন উপদেষ্টা নাহিদের কাছ থেকে আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল মসজিদটি নির্মাণের। কিন্তু এর দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি এখনও দেখা যায়নি। তাছাড়া শহীদ সাজিদের নামে উপজেলার ধনবাড়ি ডিগ্রি কলেজের নাম পরিবর্তনের জন্য গণস্বাক্ষর কার্যক্রম শেষে যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করলেও সেটা কোথায় যেন আটকে আছে।

সাজিদের একমাত্র বড় বোন ফারজানা হক আমার দেশকে জানান, সাজিদের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ি উপজেলার বিলকুকরী গ্রামে হলেও তার জন্ম ঢাকায় ১৯৯৯ সালের ১ মার্চ। সাজিদ ছোটবেলা থেকেই ছিল দুরন্ত ও মেধাবী। তার ইচ্ছে ছিল গ্রামে একটি মসজিদ করার।

চাকরি হলে অসহায় মানুষদের খাওয়াবে, চিকিৎসার প্রয়োজন হলে তাদের পাশে দাঁড়াবে। সাজিদ এমন এক সময় চলে গেল যখন পরিবারের হাল ধরার কথা ছিল। ওর পরিবারের একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করেছে। এর জন্য সব সময় কৃতজ্ঞ থাকব। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেন আমার বাবা-মায়ের নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখে এবং তারা যেন বৃদ্ধ বয়সে ছেলে হারানোর বেদনা নিয়ে চিকিৎসাসহ কোনো আর্থিক সংকটে না পড়েন- সেই খেয়ালটিও রাখবে বলে আশা করি।

সাজিদের বাবা জিয়াউল হক বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার। তিনি আমার দেশকে বলেন, লেখাপড়ার পাশাপাশি সাজিদ টিউশনি করত। সে আমাকে বলত, আর কয়েকটি মাস মাত্র। এরপর আমাকে আর চাকরি করতে দেবে না। গ্রামের সব আত্মীয়-স্বজনকে একদিন দাওয়াত করে খাওয়াতে চেয়েছিল। কিন্তু আর খাওয়ানো হলো না।

সাজিদকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় গত ৭ সেপ্টেম্বর কাফরুল থানায় হত্যামামলা দায়ের করেন সাজিদের বাবা জিয়াউল হক। এতে ৭৩ জনকে আসামি করা হয়। আসামিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে এবং অনেকেই বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে জানান বাদী। মামলার কোনো অগ্রগতি তো নেইই, উল্টো বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর রেজাউল করিম আমার দেশকে জানান, আমরা ইতোমধ্যে নতুন ভবনের নাম ‘শহীদ সাজিদ ভবন’ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সিন্ডিকেট সভায় এটি পাস হলেই বাস্তবায়িত হবে। সাজিদের বোনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দিতে পেরেছি। পরিবারের জন্য অর্থ বরাদ্দের বিষয়টিও বিবেচনাধীন। মামলার অগ্রগতি নিয়ে জানতে চাইলে পরিবারের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কথা বলবে বলেও জানান তিনি।

তথ্যসূত্র: বাসস

#Tales of july

Post a Comment

Previous Post Next Post