বিজয় মিছিল থেকে বাড়ি ফেরা হলো না শহীদ শাহাদাতের

 

‘ছাত্র জনতার বিজয় হয়েছে। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। আমরা আনন্দ করছি। আনন্দ মিছিল করছি, মিছিল নিয়ে এলাকার দিকে আসছি। তুমি কোন চিন্তা করো না। কিছুক্ষণ পর বাসায় আসছি...’ ফোনে স্ত্রীকে কথাগুলো বলছিলেন শহীদ শাখাওয়াত হোসেন শাহাদাত।

‘কিন্তু হঠাৎ কথার মাঝখানে ফোন হাত থেকে পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাই। এরপর আর ফোনে পাওয়া যায়নি তাকে। হয়তো তখনই গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি।’ বাসস এর সাথে এসব কথা বলছিলেন শহীদ শাখাওয়াত হোসেনের স্ত্রী হাজেরা বেগম (৪৫)।

হাজেরা বেগম বলেন, পরে আমার স্বামী বাসায় আসল ঠিকই, কিন্ত লাশ হয়ে। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। আমার তিন মেয়ে ও এক ছেলে এতিম হয়ে গেল। আল্লাহ তাদের বিচার করবেন নিশ্চয়। ৫ আগস্ট আনন্দ মিছিল নিয়ে ফেরার পথে গুলিতে প্রাণ যায় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের শাখাওয়াত হোসেন শাহাদাত (৬১)। 

নিহত শাখাওয়াত কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ইলাশপুর ধনপুর গ্রামের আবদুল মজিদের পুত্র। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ৩ মেয়ে ও এক পুত্র রেখে গেছেন। এলাকায় দানশীল ও সমাজসেবক হিসেবে পরিচিত শাখাওয়াত হোসেন শাহাদাত ইলাশপুর জামে মসজিদ এবং মাদ্রাসার সভাপতি ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে টঙ্গিতে গ্রোসারির ব্যবসা করতেন। 

তার তিন মেয়ের মধ্যে মাহমুদা আক্তার (৩০) ও সুমাইয়া আক্তার (২১) এর বিয়ে দিয়েছেন। একমাত্র ছেলে আবু নাসের হামজা (২৬) এবার কামিল পাস করেছেন। ছোট মেয়ে হাফেজ ফাতেমা আক্তার (১৬) তামিরুল মিল্লাত টঙ্গী শাখায় নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী।

পরিবার সূত্রে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে টঙ্গি থেকে ঢাকায় যাচ্ছিলেন শাখাওয়াত হোসেন শাহাদাত। কিন্তু ঢাকার বিজয় সরণি যাওয়ার পর জানতে পারেন গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। 

এরপর রাজনৈতিক সহকর্মীদের সাথে আনন্দ মিছিল নিয়ে টঙ্গিতে ফিরছিলেন তিনি। কিন্তু তার আর ফেরা হয়নি। ঢাকার উত্তরা আজমপুর এলাকায় গুলিতে নিহত হন শাখাওয়াত। তার মাথা ও পেটে দুটি গুলি লাগে।

শাখাওয়াত হোসেনের জামাতা ইকবাল হোসেন বলেন, ব্যবসায়িক কাজে তিনি দীর্ঘদিন থেকেই টঙ্গিতে বসবাস করতেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সেই কর্মসূচিতে যোগ দিতে তিনি ও তার অন্য রাজনৈতিক সহকর্মীরা মিলে টঙ্গি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন।

তারা ঢাকায় বিজয় সরণি এলাকায় যাওয়ার পর খবর আসে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেছেন। এরপর তারা আনন্দ মিছিল করতে করতে টঙ্গিতে ফেরার জন্য রওনা হন বলে জানান তিনি। 

তিনি বলেন, কিন্তু ফেরার পথে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে উত্তরা আজমপুর এলাকায় তাদের লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি ছুঁড়তে থাকে। এসময় আমার শ্বশুরের মাথায় ও পেটে গুলি লাগে। তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় জাহানারা ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার না থাকায় সেখান থেকে টঙ্গি মেডিকেলে আনা হলে সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। 

ইকবাল হোসেন বলেন, পরে ওই দিন রাত ৯টার দিকে টঙ্গিতে তার প্রথম নামজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সেখান থেকে আমরা মরদেহ নিয়ে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা হই। রাত সাড়ে ৩টার দিকে আমরা চৌদ্দগ্রাম পৌঁছাই। পরদিন ৬ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়।

তিনি বলেন, আমার শ্বশুর অত্যন্ত সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষ ছিলেন। তার এই মর্মান্তিক মৃত্যু আমরা মেনে নিতে পারছি না। তাকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমরা ক্ষতিপূরণসহ এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।

অনুদান পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদ শাহাদাতের ছেলে আবু নাসের হামজা জানান, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী গাজীপুর টঙ্গী দক্ষিণ থানার পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে। এছাড়া আর কোন অনুদান পাননি।

ইলাশপুর জামে মসজিদ ও মাদ্রাসার সাধারণ সম্পাদক মো. শাহিন মজুমদার বলেন, মাওলানা শাহাদাত ভাই দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। প্রবাস থেকে দেশে আসার পর এলাকায় সকল সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন। এ মাদ্রাসায় তিনি দীর্ঘদিন ধরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।

প্রবাসে থাকার সময় এই মাদ্রাসার প্রায় ৪০ থেকে ৩৫ লাখ টাকার কাজ করেছেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন মাদ্রাসায় অনুদান দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন।

গ্রামের অসহায়দের সহায়তায় সবসময় আগে থাকতেন। কোনো গরীবের মেয়ের বিয়ে না হলে তিনি তার বিয়ের ব্যবস্থা করে দিতেন। তার মৃত্যুতে এলাকাবাসী গভীরভাবে শোকাহত।

ইলাশপুর মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা জাহিদুল ইসলাম জানান, শাখাওয়াত হোসেন শাহাদাত সভাপতি হিসেবে প্রতিনিয়ত মাদ্রাসার শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করতেন। শিক্ষকদের সব সময় সম্মান করতেন। অসাধরণ মনের মানুষ ছিলেন তিনি।

শহীদ শাহাদাতের ভগ্নিপতি ক্যাপ্টেন (অব.) মো. আমজাদ হোসেন জানান, ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের সময় যারা তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, দেশের মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে গণহত্যা চালিয়েছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।

সংবাদ: বাসস

#Tales_of_July

Post a Comment

Previous Post Next Post