১৯ জুলাই ২০২৪। আজও সেই দিনটির প্রতিটি মুহূর্ত স্পষ্ট মনে পড়ে। দিনটি আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার দিন, যেন এক রক্তাক্ত অধ্যায়। সেদিন সকাল থেকেই আমাদের মিছিল আর স্লোগান শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে আমরা, দেশের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী, একত্রিত হয়েছিলাম। প্রশাসনের অন্যায় আর বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে আমাদের কণ্ঠস্বর ছিল নির্ভীক, কিন্তু কেউই হয়তো ভাবিনি, সেই দিনটি এতটা ভয়াবহ হয়ে উঠবে।
সকাল থেকেই যাত্রাবাড়ীর রাস্তায় আমাদের অবস্থান। সব তরুণ মনেই ছিল একজোট হওয়ার শক্তি, ন্যায়ের জন্য লড়াইয়ের প্রত্যয়। আমার সাথে ছিল আমার সহপাঠীরা, বন্ধুরা—যাদের চোখে স্পষ্ট ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটুকরো অগ্নিশিখা। স্লোগানের পর স্লোগান, প্রতিবাদের পর প্রতিবাদ চলতে থাকে। পুরো এলাকাজুড়ে যেন এক আন্দোলনের বন্যা বইছিল। আমরা সেদিন নিজেদের অধিকার আর বৈষম্যহীনতার দাবিতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, স্লোগানে স্লোগানে গর্জে উঠছিলাম।
কিন্তু বিকেল গড়াতেই পরিস্থিতি বদলে যায়। হঠাৎ চারদিক থেকে পুলিশ এসে আমাদের ঘিরে ফেলে। আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে তারা বলপ্রয়োেগ করে থামাতে চেয়েছিল। প্রথমে শুরু হলো কাঁদানে গ্যাসের গোলা। চোখে ধোঁয়ায় ঝাঁঝালো জ্বালা ধরছিল, কিন্তু তবুও আমরা থামিনি। এরপর শুরু হয় লাঠিচার্জ। যেখানেই তাকাই, সেখানেই দেখি বন্ধু, সহপাঠীরা লাঠির আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে। তবুও আমরা সেদিন পিছু হটতে রাজি ছিলাম না। আমরা জানতাম, এই লড়াই একদিন ইতিহাস হয়ে থাকবে।
সন্ধ্যার দিকে পরিস্থিতি যখন আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে, তখনই শুরু হয় গুলিবর্ষণ। এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়া হচ্ছিল, এবং প্রতিটি গুলি যেন আমাদের ন্যায়ের প্রতীককে আঘাত করছিল। আমি সেই ভিড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ভাবতে পারিনি যে পরবর্তী মুহূর্তেই আমার নিজের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়বে। হঠাৎই অনুভব করলাম এক প্রচণ্ড আঘাত, এবং আমার শরীর যেন ভেঙে পড়ল। পুলিশ আমাকে লক্ষ করে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়েছে-আমার শরীরের ওপর পড়ে যায় ২০০টিরও বেশি গুলি। আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। চারপাশে শুধু রক্ত, ধোঁয়া, আর চিৎকার।
মাটির ওপর পড়ে আমি রক্তে ভেসে যাচ্ছিলাম। ব্যথায় চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল, আর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু নিজের শেষ মুহূর্তের কষ্টের মধ্যেও আমি বুঝতে পারছিলাম, চারপাশে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি। গুলি চালানোর পরও পুলিশ আর ছাত্রলীগের বাহিনী আমাদের ছেড়ে দেয়নি। আমার সহপাঠীরা একে অপরকে সাহায্য করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসারও সাহস পাচ্ছিল না।
গুরুতর আহত অবস্থায় সেখান থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু শরীর যেন আমাকে সাড়া দিচ্ছিল না। সবাই বলছিল আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, কিন্তু রাস্তাগুলি ছিল পুলিশের দখলে। এমনকি ঢাকার প্রধান হাসপাতালগুলোও আমাদের জন্য নিরাপদ ছিল না। আমাদের আহতদের সাহায্য করার মতো কোনো উপায় ছিল না। রাতে মাটির ওপর শুয়ে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছিল, আজই হয়তো আমার জীবনের শেষ রাত।
পুরোটা রাত সেই রক্তাক্ত অবস্থাতেই কাটাতে হয়েছিল। চারপাশের নিঃশ্বাস আর শ্বাসরুদ্ধ অবস্থার মধ্যে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলাম। প্রচণ্ড ব্যথায় আমি চোখ বন্ধ করতে পারছিলাম না, চোখের সামনে মাটি, রক্তের ছোপ, আহত বন্ধুর মুখ আর কানে বাজছিল চিৎকার। চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারিনি, মাটির ওপরে পড়ে ছিলাম আর মনে হচ্ছিল আমার শরীরের প্রতিটি অংশে যেন জ্বালাময়ী যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়েছে। সারা রাত ভয়ে, কষ্টে, আর অসহায়ত্বে কাটিয়েছিলাম, জানতাম না, এই রাতের শেষে আলোর দেখা পাবো কিনা।
সেদিন ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর রাত। কিন্তু এই যন্ত্রণার মাঝেও মনে হচ্ছিল, আমাদের লড়াই কখনও বৃথা যাবে না। আমাদের রক্তের প্রতিটি বিন্দু সেই আন্দোলনের সাক্ষী হয়ে থাকবে। ১৯ জুলাইয়ের সেই স্মৃতি আজও আমাকে সাহস জোগায়, আর মনে করিয়ে দেয়, আমাদের ত্যাগ একদিন ইতিহাস হয়ে থাকবে।
Post a Comment