মাথার গোঁজার একটি ঠাঁই চান শহিদ ইউসুফের স্ত্রী সাজেদা আক্তার

 


হাটহাজারী উপজেলার ধলই ইউনিয়নের পশ্চিম ধলই গ্রামের জলিল কোম্পানিতে তাদের বাড়ি। তিনি ছিলেন একমাত্র পুত্র সন্তান। ছোট তিনবোন, সকলের বিয়ে  হয়ে গেছে। 

মোঃ ইউসুফ (৩৬) পেশায় একজন ভ্যান চালক ছিলেন। চট্টগ্রাম শহরের ঈদগাহ ঝর্ণা পাড়া এলাকায় একটি বরফ কারখানায় কাজ করতেন।

ভ্যানে করে নগরীর হাট-বাজারগুলোতে বরফ সরবরাহই তাঁর কাজ ছিল। কারখানার একপাশে ছোট একটি রুমে অন্যান্য শ্রমিকের সাথে থাকতেন। স্ত্রী ও তিন সন্তান থাকে গ্রামের বাড়িতে। পরিবারকে দেখতে তিনি প্রতি সপ্তাহে গ্রামের বাড়িতে আসতেন। দু’একদিন থাকার পর আবার শহরে কর্মস্থলে চলে যেতেন। 

ইউসুফের বাবা ইউনুছ পরিবার নিয়ে একসময় নগরীর কোতোয়ালি থানাধীন ফিরিঙ্গী বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। সেখানে প্রতিবেশী কিশোরী সাজেদা আক্তার (২৮) এর সাথে ইউসুফের সখ্য গড়ে ওঠে। পরে তারা বিয়ে করেন। পরিবারের অমতে বিয়ে করায় ইউসুফের স্ত্রী সাজেদা আক্তারকে মেনে নেয়নি তাঁর বাবা-মা। ফলে ইউসুফ পরিবার থেকে আলাদা হয়ে স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া বাসায় বসবাস করতে থাকেন। 

আর্থিক টানাপোড়নের কারণে দুই বছর আগে স্ত্রী সন্তান নিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে আসেন ইউসুফ। কিন্তু তাদের ঘরে জায়গা দিতে অস্বীকৃতি জানান তাঁর বাবা-মা। তখন ভাতিজার কষ্ট দেখে এগিয়ে আসেন চাচা মাহবুবুল আলম। নিজের বাড়ির কোণে ছোট্ট একটি জায়গা দেন তাদের থাকার জন্য। একটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে সেখানে টিন দিয়ে এক রুমের একটি ঘর তৈরি করে নেন ইউসুফ। 

গত বছরের ৫ই আগস্ট, রাত ১২টা। গৃহবধূ সাজেদা আক্তার সারাদিনের গৃহস্থালি কাজ সেরে ঘুমাতে এসেছেন। আজ সারাদিন কোন কাজেই তিনি মন বসাতে পারেননি। অজানা এক অস্থিরতা তার মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল। চোখে ঘুম নেই। তাই শুয়ে শুয়ে দোয়া-দরুদ পড়তে লাগলেন।

এ সময় হঠাৎ তার মোবাইলটা বেজে উঠল। 

রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে অপরিচিত এক ব্যক্তি জানতে চান,‘এই মোবাইলের মালিক আপনার কে?’

তিনি বলেন, আমার স্বামী। 

ঐ ব্যক্তি বলেন, ‘আপনার স্বামী মারা গেছেন। কয়েকজন লোক তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। লাশ রেখে তারা চলে গেছে। মোবাইলটি তাঁর শার্টের পকেটে ছিল। ডায়াল লিস্ট দেখে ফোন করেছি।’

কথাটা শুনেই সাজেদা আক্তারের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। মুহূর্তের মধ্যেই পায়ের তলার মাটি যেন আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগলো। সন্ধ্যা ৭টায় তো স্বামীর সাথে কথা বলেছেন। এই ধরনের পরিস্থিতিতে বের হওয়ার কারণে স্বামীকে অনেক বকাঝকাও করেছেন। স্বামী ইউসুফ সান্ত্বনা দিয়ে তাকে বলেছিলেন, ‘চিন্তা করো না। কিছুই হবে না। আমার সাথে আল্লাহ-রসূল আছেন। বরফ নিয়ে বিয়ের ক্লাবে যাচ্ছি। রাতে কথা বলবো।’

একথা বলে তিনি মোবাইলের লাইন কেটে দেন।

তাই স্বামী যে আর বেঁচে নেই বিষয়টি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি। দৌড়ে গিয়ে পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে খবরটি জানালেন।

বোরকা পরে শহরে আসার জন্য পাগলের মতো দিকবিদিক ছুটোছুটি করতে লাগলেন। কিন্তু রাস্তাঘাটের পরিবেশ খুবই খারাপ। চারিদিকে থমথমে অবস্থা। যেন যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। এমন পরিস্থিতিতে এত রাতে গাড়ি পাওয়া মুশকিল। তাই কেউ শহরে যেতে রাজি নন।

সংবাদের সত্যতা যাছাইয়ের জন্য সাজেদা আক্তার শহরে তার সেজ বোন রাবেয়া বসরীকে ফোন করলেন। রাবেয়া রাত ২টায় বোনের স্বামীর খোঁজে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যান। জরুরি বিভাগে এসে দেখেন হাসপাতালের বেডে পড়ে আছে বোনের স্বামী ইউসুফের নিথর দেহ। শরীর থেকে বেয়ে বেয়ে রক্ত পড়ছে। রক্তে তার সারা শরীর ভিজে গেছে। তিনি ইউসুফ, ইউসুফ বলে চিৎকার করতে থাকেন। ফোন করে ছোট বোন সাজেদা আক্তারকে জানান যে, তার স্বামী সত্যি সত্যি মারা গেছেন। রাত ৩.৩০ মিনিটে কয়েকজন মানুষের সহযোগিতা নিয়ে এ্যাম্বুলেন্সে করে তিনি ইউসুফের লাশ নিয়ে বোনের শ্বশুর বাড়িতে আসেন। 

সাজেদা আক্তারের গগনবিদারী কান্না আর স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে শহিদ ইউসুফের বাড়ির পরিবেশ। শুক্রবার বিকেলে সুস্থ ইউসুফ বাড়ি থেকে শহরে কাজে গিয়েছিলেন। আর সোমবার রাতে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরলেন। ৬ই আগস্ট দুপুর ১২টায় পারিবারিক কবরস্থানে ইউসুফকে দাফন করা হয়। 

চোখের পানি মুছতে মুছতে বাসস প্রতিনিধিকে ঘটনার এসব বিবরণ দিচ্ছিলেন শহিদ ইউসুফের স্ত্রী সাজেদা আক্তার।

জানা গেছে, গত ৫ই আগস্ট স্বৈরাচারী হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর দিন রাত ৮টার সময় দেওয়ানহাট এলাকায় ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলে পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা অতর্কিত গুলিবর্ষণ শুরু করে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান হতভাগ্য ভ্যান চালক ইউসুফ। পথচারীরা তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। 

সাজেদা আক্তারের গ্রামের বাড়ি মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ি ইউনিয়নের পশ্চিম পাড়া এলাকায়। মাত্র এক বছর বয়সে বাবা মো. কাশেম ও মা লায়লা বেগম দু’জনকে হারান তিনি। পিতৃমাতৃহীন সাজেদা বেড়ে ওঠেন ভাইদের সংসারে। আঠার বছর বয়সে শহরে বোনের বাসায় বেড়াতে গেলে পরিচয় হয় ইউসুফের সাথে। বিয়ের পর স্বামীকে নিয়ে কয়েক বছর চট্টগ্রাম শহরের টাইগারপাস এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করেন।

সংসারের খরচ বেড়ে যাওয়ায় দুই বছর আগে ইউসুফ তাদের গ্রামে নিয়ে আসেন।

মাথা গোঁজার ঠাই নেই, আছে অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা। পরিবারের একমাত্র উপার্জক্ষম স্বামীকে হারিয়ে দিশেহারা সাজেদা আক্তার আক্ষেপ করে বলেন, আমার তিন সন্তান।

বড় ছেলে মো. জুনায়েদ (১০) ক্লাস টু তে পড়ে। মেয়ে আলিফা আক্তার ক্লাস থ্রি তে পড়ে। আর ছোট ছেলে আলী হোসেন (৪) এখনও স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। বড় ছেলেটা বছর কয়েক আগে মাথায় আঘাত পাওয়ায় এখনো অসুস্থ। স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে না।

তিনি প্রশ্ন করেন, স্বামী বেঁচে নেই। এখন এ সংসার কিভাবে চলবে? তিন অনাথ সন্তানকে নিয়ে কোথায় যাব? সন্তানদের পড়ালেখার খরচ কিভাবে যোগাড় করবো? চাচা শ্বশুরের ভিটিতে কতদিন থাকবো? সারাদিন মাথায় এই প্রশ্নগুলোই ঘুরপাক খায়। উত্তর তো পাইনারে ভাই। আমাদের গরীবের আল্লাহ ছাড়া কেউ নাই। জন্মের পর থেকে তো দুঃখ পিছু ছাড়ছে না।

স্বামী হত্যার বিচার চান কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কার কাছে বিচার চাইবো? আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম। আল্লাহ বিচার করবে। আর কোন বিচার চাই না। হাসিনা যদি শুরুতে ছাত্রদের দাবি মেনে নিত তাহলে আমার স্বামীকে মরতে হতো না। শত শত মা-বোনের বুক খালি হতো না। আজকে কেউ স্বামী হারা, কেউ সন্তান হারা, কেউ ভাই হারা। কে ফিরিয়ে দেবে তাদের?

সরকারের কাছে কোন দাবি আছে কি না জানতে চাইলে সাজেদা বলেন, আমার মাথা গোঁজার কোন ঠাঁই নেই। তিন সন্তানকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। সরকার যদি একটা থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে দেন তাহলে আমার একটা আশ্রয় হবে। বাচ্চাগুলো নিয়ে আমি যেন দুইটা ডাল-ভাত খেতে পারি সেই ব্যবস্থা করে দেন। অন্যথায় বাচ্চাগুলো নিয়ে ভিক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।

সাজেদা আক্তারের বড় বোন আমেনা বেগম বলেন, আমার বোনের স্বামী খুবই শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছিল। সে আমার নিজের ভাইয়ের মতো ছিল।

কোনদিন কারোও সাথে ঝগড়া-বিবাদ করেনি। কেউ কিছু বললে কখনো প্রতিবাদ করতো না। এমন নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

সে তো কোন দোষ করেনি, অন্যায় করেনি। তাহলে কেন তাকে মরতে হলো? তিনটা এতিম সন্তানের দায়িত্ব এখন কে নেবে? কেউ কি বাচ্চাগুলোকে তাদের বাবাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে? সকারের কাছে একটাই আবেদন এতিম বাচ্চাগুলোর থাকার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যেন একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবি এম মশিউজ্জামান বাসস প্রতিনিধিকে বলেন, ‘পরিবারটি খুবই অসহায়।

ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসন থেকে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে পরিবারটির পাশে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অনেকেই সযোগিতা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

সংবাদ: বাসস

#Tales_of_July

Post a Comment

Previous Post Next Post