ছেলে আমার ঠিকই বাড়ি ফিরেছিল। তবে..


মা নিষেধ করেছিলেন। বলেছিলেন, বাবা যাস নে। তোকে হারালে যে আমাদের দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে। ছেলে কথা শোনেনি মায়ের। যোগ দিয়েছিল বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। জীবিত আর ঘরে ফেরা হলো না তার। মায়ের দুনিয়া সত্যিই অন্ধকার হয়ে গেল।

বলছিলাম সবুজ মিয়ার কথা। বয়স ছিল তার ১৮। বাধা না মানার বয়স। আন্দোলনে যোগ দিয়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে শহিদ হয়েছেন তিনি।

সবুজ মিয়া শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার খড়িয়াকাজিরচর ইউনিয়নের রূপারপাড়া গ্রামের আজহার আলী (৫০) ও সমেজা খাতুন (৩৮) দম্পতির ছেলে।

তিনি এ বছর শ্রীবরদী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। পরীক্ষায় জিপিএ ৪ দশমিক ৩৩ ‘এ’ গ্রেড পেয়ে উত্তীর্ণও হয়েছেন।

শহিদ সবুজের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবুজ দ্বিতীয়। বোনের বিয়ের পর বাবা প্যারালাইজড হয়ে পড়েন। এরপর পরিবারের সকল দায়িত্ব নেন সবুজ। পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি ফার্মেসীতে কাজ করতেন। পরিবারের খরচ চালানোর পাশাপাশি নিজের আয়ে পড়াশোনাও করতেন।

সবুজের চাচাত ভাই রাশেদুজ্জামান রিফাত বলেন, সবুজের বাবা দীর্ঘদিন থেকে প্যারালাইজড থাকায় সংসারের পুরো দায়িত্ব ছিল সবুজের কাঁধে। এস এস সি পাশ করার পর পরিবারের খরচ বহন করতে সবুজ চলে যায় ঢাকায়। দীর্ঘদিন চাকুরি করার পর সে শেরপুর ফিরে এসে শ্রীবরদি কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হয়। পড়ালেখার পাশাপাশি সবুজ শ্রীবরদি উপজেলার লংগরপাড়া বাজারের একটি ফার্মেসিতে চাকুরি করতো। তার বেতন ছিল মাত্র ৬ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়েই তার অসুস্থ বাবার চিকিৎসা, পরিবার ও তার পড়াশোনার খরচ চলতো।

সবুজের মা সমেজা খাতুন (৩৮) বলেন, গত ৪ আগস্ট সবুজ সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আমি তাকে যেতে নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম, বাবা যাস নে। শোনেনি আমার কথা। সে সময় আমার দেশ প্রেমিক ছেলে বলেছিল, ‘সবাই যদি ভয়ে ঘরে বসে থাকে তাহলে আওয়ামী সরকারের পতন হবে না। আর আমরা কখনো আমাদের যৌক্তিক দাবীগুলো শেখ হাসিনাকে দিয়ে মানাতে পারবো না।’ সেদিন সবুজ বলেছিল, ‘মা চিন্তা করো না। আমি মিছিল শেষ করে বাড়ি ফিরে আসবো।’ ছেলে আমার ঠিকই বাড়ি ফিরেছিল। তবে লাশ হয়ে।

সমেজা আরও জানান, আমার ছেলে আমাকে খুবই ভালবাসতো। কখনো বাড়ি এসে দেখতে না পেলে এদিক সেদিক খুঁজতো। সবুজ ভাল কবিতা লিখতো। মাঝে মধ্যে আমাকে তার লেখা কবিতা পড়ে শুনাতো। দেশের প্রতি তার খুব টান ছিল। সবুজ খুব সাহসীও ছিল। তার স্বপ্ন ছিল সে একদিন বড় ব্যবসায়ী হবে। তখন আমাদের কোন দুঃখ কষ্ট থাকবে না। আমার ছেলের মৃত্যুর জন্য যারা সত্যিই দায়ী আমি তাদের বিচার চাই।

জাহিদ মেডিকেলের স্বত্বাধিকারী জাহাঙ্গীর আলম (৩৫) সম্পর্কে সবুজের চাচা হন। তিনি বলেন, ছেলেটা খুবই ভদ্র ও বিনয়ী ছিল। সে আমার ফার্মেসীতে চাকুরি করত। ছোটবেলা থেকে সবুজ অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছে। সবুজ তার বাবার চিকিৎসার খরচ চালানোর জন্য ঢাকায় গিয়েছিল। সেখানে সে বাড়ির কেয়ারটেকারের কাজ করেছে। এরপর অনেকদিন গার্মেন্টসেও কাজ করেছে। তার স্বপ্ন ছিল সে একদিন বড় ব্যবসায়ী হয়ে পরিবারের দুঃখ ঘুচাবে। কিন্তু অসময়ে তার এ মৃত্যুতে সব শেষ হয়ে গেছে।

তথ্যসূত্র: বাসস 


#Tales_of_July

Post a Comment

Previous Post Next Post