জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত ৮টি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

 

১. মৃত্যুর সংখ্যা: প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আন্দোলন চলাকালে কমপক্ষে ১,৪০০ জন শহিদ হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশই শিশু। হাজার হাজার মানুষ স্থায়ীভাবে আহত হয়েছেন। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনরত শত শত আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা বাহিনী পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে হত্যা করেছে এবং আন্দোলনের মাঠে থাকা রিপোর্টারদের ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, যেখানে কমপক্ষে ২০০ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। 


২. মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ: প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের করা অনেক হত্যাকাণ্ড রোম স্ট্যাটুটের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধ। বেশ কিছু ক্ষেত্রে, নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র প্রতিবাদকারীদের পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে হত্যা করেছে, যা তাদের হত্যার স্পষ্ট উদ্দেশ্য নির্দেশ করে। 


৩. অপরাধীদের পরিচয়: প্রতিবেদনে সাতটি নিরাপত্তা বাহিনীর সমন্বিত ভূমিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যারা যৌথভাবে প্রতিবাদকারীদের নির্বিচারে গ্রেফতার, নির্যাতন এবং এমনকি হত্যা করেছে। এই বাহিনীগুলো হলো: বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই), ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স (এনএসআই) এবং ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি)। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অবৈধ নজরদারি, চিকিৎসা সেবায় বাধা এবং ছাত্রনেতাদের গুমের সাথে জড়িত ছিল। এছাড়া, ছাত্রলীগকে আন্দোলনকারীদের ওপর সহিংস আক্রমণের জন্য মোতায়েন করা হয়েছিল; তারা পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে মিলে মেশিন, লাঠি এবং আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে। 


৪. নারী আন্দোলনকারীদের কৌশলগত লক্ষ্যবস্তু করা: প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্দোলনে যুক্ত থাকা নারীদের ওপর, বিশেষ করে নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকরা যৌন প্রতিহিংসা চালিয়েছে। এটি প্রতিবাদ দমনের একটা কৌশল। ছাত্রলীগের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনরত নারীদের মারধর, স্পর্শকাতরভাবে হাতাহাতি ও ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেও এসব হয়েছে, কিন্তু তারা কিছু করেনি। বন্দিদশায়ও পুলিশ, ডিজিএফআই ও র্যাব কর্মকর্তারা নারী আন্দোলনকারীদের যৌন হয়রানি, অমানবিক আচরণ ও ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে। কিছু বন্দিকে জেরা কালে ধর্ষণ করা হয়েছে বলেও রিপোর্টে উল্লেখ আছে। যৌন হয়রানির সাথে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার সুযোগ থাকে বলে ধারণা করা যায়, এই ধরণের অত্যাচারের ঘটনা প্রতিবেদনের চেয়েও অনেক বেশি হতে পারে।


৫. চিকিৎসা সেবায় বাধা এবং চিকিৎসা নথি জালিয়াতি: প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশি নিরাপত্তা বাহিনী আহত আন্দোলনকারীদের চিকিৎসা সেবায় কৌশলগতভাবে বাধা সৃষ্টি করেছে। পুলিশ, র্যাব, ডিজিএফআই এবং এনএসআই কর্মীরা হাসপাতালগুলোতে অবস্থান করে ডাক্তারদের ভয় দেখিয়েছে এবং তাদেরকে চিকিৎসা প্রতিবেদন জালিয়াতি করতে বা আহতদের চিকিৎসা দিতে বাধা দিয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স আটকানো হয়েছে, আহত আন্দোলনকারীদের হাসপাতালের বেড থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে, এবং চিকিৎসা নথি বাজেয়াপ্ত বা পরিবর্তন করা হয়েছে যাতে রাষ্ট্রের সহিংসতার প্রমাণ লুকানো যায়। 

মৃত্যুর কারণ ভুলভাবে দেখানোর জন্য ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের বাধ্য করা হয়েছিল, যাতে নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত হত্যার প্রমাণ লুকিয়ে রাখা যায়। চিকিৎসকদের হুমকি দেওয়া হয়েছিল, আর মৃতদের পরিবারকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বা হাসপাতালে না যাওয়ার জন্য বাধ্য করা হয়েছিল, যাতে হতাহতের সংখ্যা কম দেখানো যায়। এগুলো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের সমতুল্য।


৬. নজরদারি এবং যোগাযোগ বন্ধের কৌশলগত ব্যবহার: প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো—ডিজিএফআই, এনএসআই এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)—নজরদারি, ভয় দেখানো এবং কৌশলগত যোগাযোগ বন্ধের মাধ্যমে প্রতিবাদ দমন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এনটিএমসি এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) লক্ষ্যবস্তু এবং দেশব্যাপী ইন্টারনেট বন্ধ করেছে, যা প্রতিবাদকারীদের সংগঠিত হতে বাধা দিয়েছে এবং রাষ্ট্রের সহিংসতার প্রমাণ ছড়িয়ে পড়া রোধ করেছে। ডিজিএফআই এবং এনএসআই ইলেকট্রনিক নজরদারি ব্যবহার করে আন্দোলনের নেতাদের ট্র্যাক করেছে, যা গণগ্রেফতার এবং জোরপূর্বক গুমের সুযোগ করে দিয়েছে। 


৭. সেনাবাহিনীর দ্বিচারিতা:

প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে যে, সেনাবাহিনী দ্বৈত ভূমিকা পালন করেছে—প্রথমে রাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন দমন-পীড়নের প্রধান অভিনেতা হিসেবে, তারপর শেখ হাসিনার শাসনের অবসান ঘটানো এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সহজতর করার একটি সিদ্ধান্তমূলক শক্তি হিসেবে। সেনাবাহিনী ২০ জুলাই ২০২৪-এ মোতায়েন করা হয়, যা পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবিকে সহায়তা করে সহিংস দমন-পীড়ন চালাতে। সৈন্যরা আন্দোলনকারীদের উপর সরাসরি গুলি চালায়, যা বিচারবহির্ভূত হত্যার কারণ হয় এবং ব্যাপক গ্রেপ্তার ও অভিযানের জন্য নিরাপত্তা প্রদান করে।

সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য অনুসারে, সেনাবাহিনী এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন ছিল এবং তা রোধ করতে কিছুই করেনি। ফরেনসিক পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, মৃত্যুর ৬৬% ঘটনার জন্য সামরিক-গ্রেডের রাইফেল (৭.৬২×৩৯ মিমি গুলি) ব্যবহৃত হয়েছে, যা কেবল সেনাবাহিনী, র্যাব এবং বিজিবির জন্য বরাদ্দ করা হয়। নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে আর্মার-পিয়ার্সিং বুলেট ব্যবহারের প্রমাণ সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত দেয়, কারণ এই অস্ত্র পুলিশ বা সাধারণ নাগরিকদের কাছে পাওয়া যায় না। ফরেনসিক ও ব্যালিস্টিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, ভুক্তভোগীদের শরীরে পাওয়া বুলেট সেনাবাহিনীর অস্ত্র থেকে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।

আগস্টের শুরুতে, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ভিন্নমত বৃদ্ধি পায়, যেখানে জুনিয়র অফিসাররা বেসামরিক নাগরিকদের উপর গুলি চালাতে অস্বীকার করে। ৫ আগস্ট, যখন লক্ষাধিক আন্দোলনকারী ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন সেনাবাহিনী এবং বিজিবি তাদের বাধা না দিয়ে পিছু হটে। এর ফলে শেখ হাসিনাকে সশস্ত্র বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়, যা কার্যত তার শাসনের অবসান ঘটায়।


৮. বিপ্লব-পরবর্তী প্রতিশোধমূলক সহিংসতা:

প্রতিবেদনটি অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রতিশোধমূলক সহিংসতা এবং জবাবদিহিতার অভাবের প্রমাণও তুলে ধরে। সরকার পতনের পর, আওয়ামী লীগের সদস্য, পুলিশ এবং শাসক দলকে সমর্থনকারী বলে বিবেচিত গণমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতা চালানো হয়। হিন্দু সম্প্রদায়, আহমদিয়া মুসলমান এবং চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলের আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর উপর আক্রমণ চালানো হয়, যেখানে তাদের ঘরবাড়ি এবং উপাসনালয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তবে অব্যাহত ভয়ভীতি প্রদর্শন ও বিচার ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে, প্রতিবাদের পরবর্তী সময়ে প্রতিশোধমূলক সহিংসতা সংঘটিত হয়েছে, যেখানে আওয়ামী লীগ সমর্থক বলে বিবেচিত নারীদের আক্রমণ, হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।

এই গণহত্যার পূর্ণ সত্য উদঘাটনের জন্য এটি প্রথম প্রচেষ্টা হোক, যাতে এই ঘটনাগুলো প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে জড়িতদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায়।


Post a Comment

Previous Post Next Post