পহেলা আগস্ট '২৪ রাত এগারোটার দিকে আমার এক প্রিয়বন্ধু ফোন করে জানালো উত্তরা ৬ এবং ৯ নম্বর সেক্টরে র্যাব-পুলিশ ব্লক রেইট দিচ্ছে। বিশেষ করে কোন্ কোন্ বাসায় রাজউক কলেজ এবং মাইলস্টোন কলেজের শিক্ষার্থী আছে তা তালিকা ধরে খোঁজ নিচ্ছে। আমার ছেলে মেঘদূত ছয় নম্বর সেক্টরে রাজউক কলেজের ঠিক পিছনের গেটের দ্বিতীয় বাসাটায় থাকে। সারারাত এক মিনিট ঘুমাতে পারেনি, বারবার পানি খাচ্ছি আর এঘর ওঘর পায়চারি করছি, ওর মা সারাদিন অফিস পিটিয়ে এসে অসাড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। ভাবলাম সমস্ত মানসিক চাপ একাই নেই, ওই ক্যান্সার পেসেন্টটাকে কিছু না বলে ঘুমোতে দেই। সকাল হতে না হতে একটা প্রাইভেট কার ভাড়া করে উত্তরার দিকে ছুটলাম, বাসায় খুব হালকা করে ওর মাকে বলে গেলাম, ঢাকার অবস্থা ভালো না, আমি ছেলেটাকে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবো। সারারাত নির্ঘুম, পেটে কোন খাবার পরেনি ;একেবারে উদভ্রান্তের মতো সাড়ে আটটা নয়টার দিকে ছেলের বাসায় পৌঁছলাম। রাস্তায় তখনও পিকেটার নামেনি, আমি জানি পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া আমার ছেলেমেয়েদের একটা বদঅভ্যাস আছে, গভীর রাতে ঘুমানো আর বেলা করে ঘুম থেকে ওঠা। ছেলেকে ঘুম থেকে টেনে তুললাম, এই সাতসকালে(ওর জন্য) ঘুমজড়ানো চোখে আমাকে দেখে একেবারে হতবিহ্বল। কোন কথা না বলার সুযোগ দিয়ে ওকে বললাম, ব্যাটা ওয়াশরুম থেকে ঘুরে আয় ;টি'শার্টটা গায়ে দে। শুধু আগামী পরীক্ষার (তখন এইসএসসি পরীক্ষা চলছিল) দুটো বই নে। বাসায় গিয়ে নাস্তা করবো। মনের ভেতর যাই থাকুক ;ছেলেমেয়ে এখনো বাপের সামনে একটি শব্দ উচ্চারণ করার স্পর্ধা রাখে না। চিৎকার-চেঁচামেচি যা কিছু করার ওর মার সাথে, কিন্তু বাপের বেলায় একদম 'সাট আপ'। যখন বাসায় ফিরছি, ততক্ষণে পুরো রাস্তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের দখলে, যেহেতু ময়মনসিংহের দিকে ফিরছি, সে কারণে প্রায় বিনাবাধায় বাসায় ফিরতে পারলাম। ততক্ষণে টেলিভিশন স্কলে দেখাচ্ছে, ডিওএইচএস এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা তাঁদের বাসায় আন্দোলনকারী ছাত্র আছে কিনা, এজন্য রেইট দেওয়ায় প্রতিবাদে বিশাল প্রতিবাদ মিছিল বের করেছে। আপনারা জানেন, যে মিছিলটা গণঅভ্যুত্থানের একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিলো।বাসায় ফিরতে ফিরতেই আমার আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে, রাজউক কলেজের মেঘদূতের ফ্রম টিচার টেক্সট মেসেজ পাঠালো,তাঁদের কলেজের দুইছাত্রকে গতরাত্রে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে, এর প্রতিবাদে কলেজ গেটে সমাবেশ হবে, সকল শিক্ষার্থীর উপস্থিত থাকতে হবে। যেহেতু কলেজের প্রিন্সিপাল সেনাবাহিনীর অফিসার, সে কারণে তিনি সরাসরি নিজে নির্দেশ জারি না করে প্রত্যেক ইয়ারে আলাদা আলাদা নোটিশ করাচ্ছেন। মেঘদুত ক্লাস সিক্সে ভর্তি হওয়ার সময় থেকে অভিভাবক হিসেবে যেকোনো যোগাযোগের জন্য আমার ফোন নাম্বার দেয়া থাকায় সকল মেসেজ আমার কাছে আসে ।
যাইহোক, যে কারণে আজকে আমি এই প্রসঙ্গের অবতারণা করলাম, শুধু একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ;যদি ৫ আগস্ট প্রায় উন্মাদ শেখ হাসিনার নির্দেশ মতো বিজিবি-র্যাব-পুলিশের সাথে সেনাবাহিনী ছাত্রজনতার মিছিলে গুলি চালাতো এবং গণঅভ্যুত্থান রুখে দিতে পারতো, তাহলে কি হতো ! আমি একজন সাধারন ছাপোষা মানুষ হিসাবে এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছেলেমেয়ের পিতা হিসেবে আমারই বা কী পরিণতি হতো !
৯০ এর গণঅভ্যুত্থানে সম্মুখ সারিতে ছিলাম, বিশ্বাস করুন ;তখন লাঠি-গুলি-টিয়ার গ্যাস-জেল-জুলুম এই বিষয়গুলো আমার কাছে যারা তেলাপোকা দেখলে ভয় পায়,ততটুকু ভয়ের উদ্রেকও করতো না।কিন্তু কেন জানি না, সেই আমি আমার ছেলেমেয়ের তুচ্ছ কোন বিপদের আশঙ্কায় একেবারে কুঁকড়ে যাই, আমি জানি না তাবৎ পিতা-মাতার, এমনটি হয় কীনা। আগে একটি লেখায় বলেছি, ৫ ই আগস্ট সকাল সাড়ে সাতটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত,আমরা দুই বুড়োবুড়ি ছেলেমেয়ের সাথে শুধুমাত্র ওদের জীবনবিপন্ন হবে এই ভাবনায় পঁচিশ কিলোমিটার দীর্ঘ পথহেঁটে মিছিলে গণভবন পর্যন্ত গিয়েছিলাম, ওইদিন গণঅভ্যুত্থানের কী ভয়ংকররূপ দুই সন্তানের পাশে থেকে তা পরিপূর্ণ উপলব্ধি করেছি। আমি নিশ্চিত, সেদিন যদি শেখ হাসিনা যেকোনো অলৌকিক উপায়ে, ক্ষমতার মসনদে টিকে যেতে পারতেন (কথার পৃষ্ঠে বলছি, আসলে ২০-৩০ হাজার মানুষ মেরে ফেললেও সেদিন তিনি এই উন্মত্ত জনতাকে রুখতে পারতেন না), যদি শেখ হাসিনার পালিত হিংস্র হায়ানার গুলিতে আমি সন্তানহারা দুর্ভাগা পিতা হয়ে বেঁচে থাকতাম, তাহলে !
৬,৭,৮ আগস্ট,এই তিনদিন ঢাকার হাসপাতালগুলোর মর্গে আমার ছেলেমেয়ের লাশ খুঁজে বেড়াতাম, চিৎকার করে কাঁদার ক্ষমতাও ওই ক্ষমতালিপ্সু উন্মাদ রমণী কেড়ে নিতো। আমার নিজের সম্পর্কে যা ধারণা, তাতে আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি ;সর্বোচ্চ এই তিন দিন, তারপর হয় সেনাবাহিনীর কোন ট্যাংকের নিচের লাফিয়ে অথবা উন্মাদের মত কোন খুনি পুলিশের ইউনিফর্ম টেনে-চেপেধরে রাইফেল কেড়ে নিয়ে নিজের বুক ঝাঁঝরা না হওয়া পর্যন্ত, ট্রিগার টিপে রাখতাম । স্রষ্টার অপার কৃপায় আমাকে বা আমার মত অনেকের 'হতভাগ্য পিতা'র ভাগ্যবরণ করতে হয়নি।
প্রায় চার মাস হতে চললো,এখনো রুটিন করে কদিন পর পর এই দুঃস্বপ্ন আমাকে তাড়া করে, আমি এখনো এই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
আমার খুব মনে হয়, আবু সাঈদ, মুগ্ধ,নাফিজ,ছোট্ট মেয়ে রিয়া ; ওদের মত দেড় হাজার শহীদের বাবা-মা-স্বজনদের মানসিক ট্রমাটা তাহলে কোন পর্যায়ের ! ট্যাংক থেকে ছুড়ে ফেলা আহনাফের কথা মনে হলে বন্ধু মহিউদ্দিন এর মুখটা চোখে ভেসে ওঠে।এখনো যাঁদের পরিবারে অন্ধ-পঙ্গু শরীরের মধ্যে বুলেট বয়ে বেড়ানো ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া কোন সদস্য আছে, তাঁদের নিত্যদিন কেমন কাটে ! ওই যে একটা বাচ্চা ছেলে, যে ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলো ;অথচ একটা হাত কেটে ফেলতে হয়েছে, তারপরও হাসতে হাসতে বলছিলো ;একটা হাত নেই তো কি হয়েছে! যদি আবার দেশের প্রয়োজন পড়ে, বাকি হাতটাও দিয়ে দেবো।এ সমস্ত তরুণ-যুবাদের কাছে দেশপ্রেম বিষয়টা আসলে কেমন ! আমরা যারা নিজের সন্তানকে নিরাপদ রাখতে গিয়ে, ওদের ঘরবন্দী করতে চাই,সেই সমস্ত ছাপোষা মানুষদের সাথে এই প্রজন্মের বাচ্চাদের চিন্তার আসলে কত পার্থক্য ! এই গণঅভ্যুত্থান কী নতুন কোন উপলব্ধি তৈরি করতে পেরেছে !
গত কিছুদিন যাবৎ শেখ হাসিনা পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে ব্যর্থ রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে যেভাবে কথা বলছে, তাতে মনে হচ্ছে সংস্কার-ফংস্কার চূলায় যাক,আগামীকালকেই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা কর।এটা কি দীর্ঘদিনের পরিকল্পনাহীন আন্দোলনের গ্লানিমোছনের জন্য বলে,নাকি ক্ষমতার বাইরে থাকতে থাকতে ধৈর্যচ্যুতির কারণে বলে, ঠিক বুঝতে পারি না। এটা তো খুব সাধারণ কথা, দেশ পরিচালনা রাজনীতিকদের কাজ, গত ১৫ বছর যাবৎ দেশতো রাজনীতিকরাই চালিয়েছে ! এতগুলো তরুণপ্রাণের বিনিময়ে রাষ্ট্রমেরামতের যে সুযোগ তৈরি হয়েছে , বিএনপি নিজেও যে এতদিন রাষ্ট্র মেরামতের কথা বলেছে ;তাঁরা এই দুর্বল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রতিপক্ষ বানাচ্ছে কেন ! সত্যিই কি কোন তৃতীয় শক্তির উত্থান হচ্ছে !
আমার খুব মনে হয়,গত চার মাসে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রআন্দোলনে যে ইস্পাতকঠিন ঐক্য ছিল তা অনেকটা ঢিলেঢালা হয়ে গেছে ;আবার সম্ভাব্য ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিএনপি যদি সরাসরি এদের বিরুদ্ধে চলে যায়,সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ তো বিন্দুমাত্র সুযোগ পেলে পুরনোচেহারায় এসব সমন্বয়কারীদের পিষে মেরে ফেলবে।তাহলে কী দাঁড়াবে '২৪ এর এই ছাত্রআন্দোলনে বিজয়ী তরুণদের ভবিষ্যৎ ! ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের মত ছাত্রজনতার রক্তের সিঁড়ি বেয়ে আবারো কি রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার মোহে সব ভুলে যাবে !ছাত্র-শ্রমিক-জনতার লাশের মিছিল কি বড় হতেই থাকবে ? এদেশের সাধারণ মানুষের সত্যিকারের মুক্তি কি কোনদিনই আসবে না ?
(উত্তর : আগামী পর্বে)
২৪/১২/'২৪
Post a Comment