রাতে বাড়ি ফিরে ডিমভুনা খেতে চেয়েছিল হৃদয়, কিন্তু ফিরলো লাশ হয়ে

 

দেশের পরিস্থিতি ভালো না, গণ্ডগোল হইতাছে, চারিদিকে খালি গোলাগুলির শব্দ। তুমি কুনহানে যাইয়ো না, বাপ। কুনহানে যাইতাম না মা... । যাইতাম না কইয়া সে কিসের লাইগ্যা যে চইলা গেল, কইতে পারলাম না। হৃদয় কথা দিয়াও কথা রাহে নাই...

বাসসের প্রতিনিধির সাথে কথাগুলো বলছিলেন মমিনুল হোসেন হৃদয়ের মা মোছাম্মৎ মরিয়ম বেগম (৪৫) ।

তিনি বলেন, আমার ২৫ বছর বয়সী একমাত্র ছেলে হৃদয়ের সাথে এটাই ছিল আমার শেষ কথা। আছিলাম বাসার নিচে, সবজির ভ্যানের দোকানে। ওর বাপেরে সাহায্য করতে দিনের কিছু সময় আমিও সবজি বেচি। ১১ টার দিকে বাসায় আইস্যা দেখি হৃদয় আজকে তাড়াতাড়ি গোসল করছে। 

‘তুমি দেহি তাড়াতাড়ি গোসল কইরা লইছো?  মা, ‘আইজ না শুক্রবার সেইজন্য গোসল কইরা লাইছি’।

আমি বললাম, ‘গোসল তো কইরা লাইছো, কিন্তু বাথরুমে তো বালতি ভর্তি কইরা কাপড় ভিজাইছো’। তহন ওয় ওর বইনেরে কয়, ‘সামিয়া তুই না কাপড়গুলা ধুইয়া লা। মায় রান্না করবো’। ছুডুডারে কইছে, ‘তুমি ঘর মুইচ্ছ্যা লাও। তাইলে মায় নামাজের সময় পাইবো’।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মরিয়ম বেগম বলেন, ‘অনেক কথাই বলছি পোলার লগে। কইছি কুনদিকে যাইয়ো না বাজান, দিনকাল খারাপ, ছোটবেলায় বাপ-মায়েরে হারাইছি, দুনিয়ার কোনদিকে কেউ নাই, তুমি তো সব শুনছো, খোদার ইচ্ছায় একমাত্র আছো তুমি। তোমার যদি কিছু হয়, ইলার পরে আর কিছু থাকতো না আমার।’

শহিদ মমিনুল ইসলাম হৃদয় ১৯ জুলাই শুক্রবার মিরপুর ১০ নম্বরে পুলিশের ছোঁড়া গুলিতে শহিদ হন। এদিন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। 

হৃদয় মিরপুরের পল্লবীতে সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজে বিএসএস ২য় বর্ষের (প্রাইভেট) শিক্ষার্থী ছিলেন। পাশাপাশি তাদের মিরপুর ডি ব্লকের, রোড ২৭, বাড়ী-১,মিরপুর ৫ নং ওয়ার্ডের ভাড়া বাসার সামনে বাবার সঙ্গে কাঁচা শাকসবজি বিক্রি করতেন। তাদের স্থায়ী ঠিকানা বাড়ি ও গ্রাম বাঞ্ছানগর,ডাকঘর-লক্ষ্মীপুর,থানা-লক্ষ্মীপুর সদর, জেলা লক্ষ্মীপুর।

তিনি বলেন, শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়তে গেল। হৃদয়ের পড়ার টেবিলে দুপুরের খাওন বাইড়া রাখছি। নামাজ শেষে বাসায় আসল, দেহি মনডা খারাপ। বড় মাইয়া সামিয়ারে জিগাই আইজকা ঘরে কি অইছে কিছু কইছস হৃদয়রে? ও বলে, ‘আমি কিছু কই নাই তো’। দুপুরের আগে ওরা তিন ভাইবোন মুরগী ভাজছে, নুডলস রানছে। কই, তাইলে তোরা যে নুডলস রানছোস হেইডা কম দিছোস, তাই ওর মন খারাপ।’ 

হৃদয় আমারে কইছে, ‘মা আইজকা বেশি কিছু রান্না কইরো না। হুদা আলু ভর্তা, ডাইল করো। আর ডিম ভুনা করো। ডিম ভুনা খাই না অনেকদিন ধইরা।’

হৃদয়ের মা বলেন, নামাজ পইড়া আইয়া আবার নুডলস খাইল। পরে ভাত খাইল, আমি বললাম, হৃদয় তুমি যে ডিমভুনা খাইলা না? কয় কি মা,রাইখ্যা দাও,আমি রাইতে খামু। দুনো বোনরে ডাইক্যা কইল, তোরা ক’লে খাইবি না, আমার ভাগেরটা, আমি রাইতে আইস্যা ভাত খামু। আমারডা রাইখ্যা দাও। আমি সেই ডিম ভুনা রাইখ্যা দিলাম।

মরিয়ম বেগম জানান, বাসায় অয় লাভ বার্ড পাখি আনছে, পালবো বইলা আনছে, তহন আমি কই কি,পাখি যে আনছোস ইতা পালবো কেডা? ইতা ময়লা-ছয়লা কইরা লায়, আমি পারতাম না। হৃদয় কয় কি মা আমারডা আমি করমু, তোমার করা লাগবো না। তুমি মাঝে মাঝে খালি আদার-পানি দিও। এরপর বাসায়ই থাকল। আছরের আজান দিল, নামাজ পড়বো, গেলগা বাইরে। খুচরা সওদাপাতি কিনতে আমিও ওর লগে বাইর হইছি। বাসার সামনে এক দোকানে গিয়া ঠাণ্ডা দুধ খাইয়া কালশী মোড়ে শাকসবজি বিক্রীর দোকানের দিকে গেছে। যাওয়ার সময় আমি কই, মরারে ভয় পাই না। আমার তো বয়স হইছে মরে যাইতে পারি। কিন্তু তগো তো বয়স হয় নাই। তরা বাঁইচ্যা থাক। কই কি কালশী রোডে তরকারি-ভ্যান আর ক্যাশ বক্স রাইখ্যা দৌড়াইয়া কারো বাড়িতে ঢুইক্যা যাইস গা। কিছু নেওয়া লাগবো না। পুলিশে তো দৌড়াইতাছে। বইতে দিতো না। এর আগে পুলিশ দুইবার উডাইয়া দিছে। 

মরিয়ম জানান, বৃহস্পতিবার মিরপুর ১০ নম্বরে পুলিশ ওর কাঁধে রাইফেলের বাঁট দিয়া বাড়ি মারছে। শুক্রবার সকাল ১১ টার দিকে দেখি ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়াইয়া কাঁধের কালশিটে দাগটায় হাত দিয়া ঢলতাছে। কাছে গিয়া কইলাম, মাইনষের থন শুনছি তুমি  মিছিলে ১০ নাম্বার গেছিলা। আইজকা কোনহানে যাইবা না। গেলে কইলাম তোমারে শিকল দিয়া বান্দমু। 

তিনি আরো জানান, বাইর হওয়ার সময় বলছি,হৃদয় কোনদিকে যাইয়ো না। পরিস্থিতি অনেকই খারাপ। শুনে হৃদয় হেসে বলে, ‘মা, মানুষ কি একটু কিছু হইলে মইরা যায়? তুমি মরারে এতো ভয় পাও’? সাবধান করলাম, বেকায়দায় পরলে কিন্তু বিপদ আছে। নিঃশ্বাসের কোন বিশ্বাস নাই। ও বলে, আমি একটা শক্তিশালী মানুষ,আমি বলে বেকায়দায় পরলে মইরা যামু,আমার মায় কি কয়? 

তিনি বলেন, হৃদয়  দরকার ছাড়া বের হতো না। আমাকে আরাম দিয়ে নিজে রান্না করতো,ঘরদোর গুছাইতো। যে সময় ঘরে থাকার কথা আমি সেইসময় থাকি বাইরে। কবরের সামনে গিয়া বইসা থাকি। দেহি ওরে, কান্দি মনে শান্তি লাগে। স্বপ্ন ছিল ছেলেডা একটা সরকারি চাকরি করবো, সবার কষ্ট শেষ কইরা দিবো। আমার কোনখানে শান্তি নাই মনে হয়, মইরা যাই। 

হৃদয়ের বাবা সাইফুল ইসলাম ওরফে বিপ্লব হোসেন (৫০) বলেন, হৃদয়ের পিছনে একটা গুলি লাগছে, সেইটা কলিজায় আঘাত লেগে সামনে দিয়া বের হয়ে গেছে। দুই হাত ভর্তি  ছররা গুলির চিহ্ন। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মারা যায় সে। ওর লাশ যখন নিয়া আসে তখন বাসার সামনে শুধু রাস্তাভর্তি মানুষ আর মানুষ। কেবল একটা কথাই শুনি ‘হৃদয় মারা গেছে,হৃদয় মারা গেছে।’

তিনি বলেন, ফুটপাতে ভ্যান গাড়িতে শাক-সবজি বিক্রী করি। গত ১৮ জুলাই দিবাগত রাইত তিনটার সময় কারওয়ানবাজারে মাল আনতে গেছি । ভোরে আইস্যা ভ্যান গাড়িতে শাকসবজি সাজাইয়া দোকানদারি শুরু করছি। তখনও আমার ছেলে বাসায় ছিল। সকালে কোনদিন তাকে দোকানে দাঁড়াইয়া বেচাকেনা করতে দেই না।

তিনি বলেন, শুক্রবারে শরীরটা ভাল লাগছিল না  বাসায় গিয়া ঘুমাতে চাইছিলাম। হৃদয় মিরপুরের ডি ব্লকে গিয়া সবসময় নামাজ পড়ে। আমি তারে কল দিয়া আসতে বলছিলাম। অন্যদিন ফোন দিলে লেট করে আসে,সেদিন কল দেওয়ার পরপরই দোকানের সামনে চইল্যা আসে। হৃদয় আমার কাছে এসে বলে, আব্বু তুমি বাসায় যাও। বাসার সামনের বাজারে সকালে বিক্রি হলেও বিকালের দিকে এসব এলাকায় শাকসবজির চাহিদা থাকে না, তাই বিকালে কালশীর মোড়ে যাইয়া দোকান বসাই। 

বিপ্লব হোসেন বলেন, হৃদয়রে  বাসায় গিয়া খাইয়া রেস্ট নিয়া দোকানে অঅসতে বলছিলাম।  বিকাল সাড়ে চারটার দিকে বাসায় দরজা খুলে দেখি হৃদয় মেঝেতে লম্বা হইয়া শুইয়া রইছে; কি জানি ভাবে। দুইতিন দিন ধইরা তার মনডা খারাপ ছিল। আমি খাওয়া খাইয়া ভাবলাম ওর সাথে কথা বলি কেনো ওর মন খারাপ। পরে ভাবলাম কথা বলতে গেলে সময় লাগবো, রাতে বলবো। কালশীতে পুলিশ সবাইরে ধাওয়া করতেছিল। বিকাল পাঁচটার দিকে ও বের হওয়ার সময় ওরে সাবধান কইরা দিলাম। সেই শেষ ওর মুখের দিকে তাকানো। আমি শুয়েছিলাম। ও যখন ভ্যান নিয়া কালশীর দিকে যাইতেছে তখন ওর মামী ওরে বলছে ঝামেলার কথা। ও শুনে বলছে, আমি যাই, না গেলে আব্বায় রাগ করবো।

বিপ্লব ডুকরে কেঁদে ওঠে বলেন, ফোন দিয়া ওর মামী বললো, ‘হেরে কালশীর দিকে যাইতে দিয়েন না। সুযোগ পাইলে কিন্তু আন্দোলনে চইল্যা যাইবো’। বললাম,‘নতুন কর্মচারীর কাছে দোকান ফালাইয়া আন্দোলনে গেলে ওর খবর আছে’। এর আগে কয়েকদিন সে আন্দোলনে গেছে। দুপুরেই চইল্যা আইস্যা সময়মতো দোকানে আমার সামনে দাঁড়াইছে। আমাকে ধরা দেয় নাই। বাসায় তিন থেকে চার ঘন্টা ঘুমাই। 

তিনি জানান, সন্ধ্যা ছয়টা সাড়ে ছয়টার দিকে আমাকে হৃদয়ের মা ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়ে বলে, ১০ নম্বরে অনেক গোলাগুলি হইতেছে, আপনি যাইয়া  ওরে বাসায় পাঠান।  ধরফড়াইয়া উঠি; কালশী গিয়া কর্মচারীসহ ভ্যানটা পাই। শুনি পুলিশের ধাওয়া খাইয়া ভ্যান গাড়ি একটা বাড়ির ভেতরে ঢুকাইয়া দিয়া হৃদয় বাইর হইয়া যায়। জানতে পারি কয়েকজন বন্ধুর কল পাইয়া সে আন্দোলনে চলে গেছে। ১০ নম্বরে পুলিশের গোলাগুলিতে হৃদয় গুলি খাইছে। শুনে বিশ্বাস করি নাই কিছুতে আমার হৃদয় নাই। এলাকায় কয়েকজন হৃদয় আছে। জানতে পারি তার এক বন্ধু হৃদয়কে নিয়া সোহরাওয়ার্দীতে যায় । 

তিনি কেঁদে  বলেন, কিভাবে বিশ্বাস করবো, শিওর হবো যে আমার হৃদয় আর নাই। একঘন্টা আগেও দোকান করছে। রাত সাড়ে আটটার দিকে হাসপাতালে যায়া দেখি হাসপাতালের মর্গের ভেতরে আলুর বস্তার মতো একটার ওপর একটা লাশ ফিক্কা (ছুঁড়ে) মারতেছে। হৃদয়ের বন্ধু ওর লাশ কোলেনিয়া বইসা আছিল।   বলছিল মর্গে আমি লাশ দিমু না, ওগোরে বলছি হৃদয়ের আত্মীয়-স্বজন আসবে, তারপর লাশ নিয়ে যাবো। 

হৃদয়ের বাবা সে সময়ের পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, ‘পুলিশের গুলিতে হৃদয় মারা যাওয়ার ঘোষণা দিলে এলাকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মসজিদের মুয়াজ্জিনসহ আমাদেরকে অনেক হুমকি দেয় এবং হৃদয়ের লাশ ধোয়ানো ও জানাজা পড়ানোর সুযোগ দিচ্ছিল না। রাত সাড়ে দশটার সময় ১২ নম্বরের ডি ব্লকের ইমাম সাহেব নিজে গোসল করায়ে জানাজা করায়। ১২ টার থেকে কারফিউ ছিল, রাস্তায় কোন মানুষ নাই, আকাশে একটা হেলিকাপ্টার চক্কর দিতে থাকে আর টর্চ লাইট জ্বালাতে থাকে বারবার। বাসার সামনে জানাজা দেওয়ার সময় রাত সাড়ে বারোটায় পুলিশের গাড়ি আসে। দশ -পনেরো মিনিটের মধ্যে জানাজা শেষ করার নির্দেশ দেয়। এক হাজারের ওপর লোক জানাজায় জমায়েত হইছে। কালশি কবরস্থানে হৃদয়ের কবর দিয়া আসা পর্যন্ত হেলিকাপ্টার আমাদের সাথে সাথে আসছে। 

বিপ্লব বলেন, ‘হৃদয়ের মৃত্যুর দুইদিন পর বাপ্পি কাউন্সিলারের অফিসে আমারে নিয়ে গেছে। বলছে শেখ হাসিনার কাছে  নিয়া সাক্ষাৎ করায়ে দেবে আমারে, দশলাখ টাকার এফডিআর করে দিবে বলে জানায়। ওই অফিসে থাকা ছেলেরা  আমাকে শিখাইয়া দিয়া বলে, আমার ছেলে যুবলীগের কর্মী, ওদের আন্দোলনে গিয়া আমার ছেলে শহিদ হইছে। আমি কাউন্সিলরের কথায় রাজি হই নাই। বলছি,সামনে তো ছেলে মারা যায় নাই, কিভাবে মিথ্যা কথা বলবো? ছেলে ব্যবসা আর লেখাপড়া করত, আমরা সাধারণ মানুষ, কর্ম কইরা খাই। হৃদয় কোন রাজনীতিতে জড়িত ছিল না। সেদিনই মিরপুর মডেল থানার ওসি ডেকে নিয়ে বলে, ‘আমারে বলতে হবে বিএনপি-জামাত মিলে আমার ছেলেরে হত্যা করছে। সে ছাত্রলীগের কর্মী ছিল, তারা গুলি কইরা মারছে।’ 

বিপ্লব বলেন, হৃদয় মারা যাওয়ার পর অনেক হুমকি ধামকির শিকার হইছি। সমন্বয়ক সারজিস স্যারসহ অনেকে আসছিল সান্ত্বনা দিতে। অনেক স্বপ্ন ছিল হৃদয় বুড়া বয়সে পরিবাররে দেখবে; তার দুই বোনকে বিয়া দিবো। হৃদয় নাই, জানি না কিভাবে জীবনে বাঁচমু, আমাগো সব স্বপ্ন হৃদয় নিয়া গেছে। 

তথ্যসূত্র: বাসস

#Tales_Of_July

Post a Comment

Previous Post Next Post