ছেলের চিকিৎসায় নেওয়া ঋণ কীভাবে শোধ করব? প্রশ্ন তারেকের মায়ের

 

আমাদের আত্মত্যাগের কারণে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। আমরা পেয়েছি নতুন এক বাংলাদেশ। আন্দোলনে আমাদের কেউ হাত হারিয়েছে, কেউ পা, আবার কেউ চোখ। কেউ প্রাণ। আমাদের চাওয়া একটাই। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ। সেখানে সবার অধিকার থাকবে সমান। যেখানে থাকবে না হানাহানি, মারামারি, দখল ও চাঁদাবাজি।

সম্প্রতি রাজধানীর তাঁতী বাজারের বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসসের প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত তারেক হোসেন এ কথা বলেন।

জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মাথায়, হাতে ও বুকে একাধিক গুলি খেয়ে আহত হয়েছেন তারেক হোসেন।

তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের সময়ে ১৯ জুলাই আমার মাথায়, হাতে ও বুকের বিভিন্ন স্থানে গুলি লাগে। আমার কপাল ভালো, আল্লাহ আমাকে সেদিন নিজ হাতে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। যে গুলিটা আমার হাতে লেগেছিল, সেটা প্রথমে একটি লোহার খুঁটিতে লাগে। তারপরে সেটা আমার হাতে এসে ঢুকে যায়। গুলিটা যদি প্রথমে লোহার খুঁটিতে না লাগতো, তাহলে সেটা আমার বুকে লাগতো। আমিও শহিদ হতে পারতাম।’

তারেক হোসেন বলেন, ‘আমার মাথার মধ্যে এখনও গুলি রয়েছে। আমার চিকিৎসা চলছে। মাঝে মাঝে অনেক ব্যথা করে। ভারি কোন কাজ করতে পারি না। চিকিৎসক বলেছেন, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। কি হবে আল্লাহ জানেন। আমার কিছু হয়ে গেলে মা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আব্বা নেই। আমি ছাড়া মাকে তো আর দেখার কেউ নেই। আমার চিকিৎসা করাতে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। মা অনেক ঋণ করেছেন। এই ঋণ যে কিভাবে শোধ করবো, তার চিন্তায় মা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। আমি যে সামান্য বেতন পাই তা দিয়ে আমাদের সংসার খরচই ঠিক মত চলে না।’

উল্লেখ্য, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এখন পর্যন্ত ৮৫৯ জন শহিদের খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তালিকায় আহতের সংখ্যা রয়েছে ১১ হাজার ৫৫২ জন। তালিকা হালনাগাদের কাজ এখনও চলছে। যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আন্দোলনে আহতরা বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এছাড়াও সরকার অনেককেই উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশেও পাঠিয়েছেন।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত তারেক হোসেন মাকে নিয়ে থাকেন রাজধানীর তাঁতীবাজার এলাকায়। আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই বিকেল সাড়ে ৩ টার দিকে সূত্রাপুর থানার লক্ষ্মীপুর এলাকায় পুলিশের গুলিতে আহত হন তারেক। নিম্ন আয়ের পরিবারে বেড়ে ওঠা ২১ বছর বয়সী তারেককে সময়ের আগেই ধরতে হয়েছে সংসারের হাল।

তারেক হোসেনের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার কাজিরহাট গ্রামে। তারেকের বাবা মো. ইলিয়াস ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর মারা গেছেন। মা সাজিয়া খাতুন গৃিহণী (৪৯)। আছমা খাতুন (২৪) নামে তারেকের একটি বোন রয়েছে। সম্প্রতি আছমার বিয়ে হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। তারেক এখন সদরঘাটে একটি দোকানে কর্মচারির কাজ করেন। পরিবারের অভাব অনটনের কারণে তারেক অষ্টম শে্িরণর বেশি লেখাপড়া করতে পারেননি।

তারেক হোসেন বলেন, ‘শুরুর দিকে প্রতিদিন কাজে যাওয়া-আসার সময় আন্দোলন দেখতাম। পুলিশের সাথে ছাত্র-জনতার ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া দেখতাম। একদিন আর সহ্য হলো না, আমিও কাজের ফাঁকে ফাঁকে আন্দোলনে যাওয়া শুরু করলাম। ১৯ জুলাই যখন লক্ষ্মীবাজার এলকায় আন্দোলন করছি হঠাৎ কোথা থেকে পুলিশ বাহিনী এলো। কথা নাই, বার্তা নাই, উল্টাপাল্টা গুলি শুরু করলো। পরিস্থিতি এমন ছিল যে আমি যদি বুক পেতে দিতাম তাহলে মা আমার লাশটাও দেখতে পাইতো না। মেইন রোড থেকে গুলি করতে করতে পুলিশ গলির ভেতরে ঢুকে পড়ে। আমিও তখন গলিতে ছিলাম। সে সময়ে প্রথমে আমার মাথায়, পেটে ও বুকে অনেকগুলো ছররা গুলি লাগে। এরপরে একটা বুলেট আমার হাতে ঢুকে যায়। আমি ৫ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। অপরেশন করতে হয়েছে। এখনও চিকিৎসা চলছে।’

তারেক আরো বলেন, ‘যখন আমার হাতে গুলি লাগে তখন গরু জবাই করলে যেভাবে রক্ত বাইর হয়, সেভাবে রক্ত পড়তে থাকে। আমি বারবার রাস্তায় পড়ে যাচ্ছিলাম। সহকর্মীরা ধরে আমাকে এলাকার একটা ফার্মেসিতে নিয়ে যায়। দোকানের লোক আমার অবস্থা দেখে শাটার বন্ধ করে দেয়। এরপর তারা আমাকে ন্যাশনাল মেডিকেলে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে।’

আন্দোলনে যোগদানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার বাবার তাঁতীবাজার মোড়ে ফুটপাতে চটপটির দোকান ছিল। স্থানীয় ছাত্রলীগ, যুবলীগ গিয়ে মাঝে মাঝে ঝামেলা করতো। একবার আমার বাবাকে ওদের ক্লাবে ধরে নিয়ে গিয়ে অনেক নির্যাতন করেছিল। সেই থেকেই আমার জিদ ছিল সুযোগ পেলে এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো। তাই আমি আন্দোলনে সক্রিয় হই।’

আহত তারেক হোসেনের মা সাজিয়া খাতুন বলেন, ‘আমরা গরীব মানুষ। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ও একাই সংসার চালায়। আল্লাহ আমার ছেলেকে বাঁচিয়েছেন। ওকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমার অনেক টাকা খরচ হয়েছে। আমি ঋণ করে টাকা নিয়ে ছেলের চিকিৎসা করেছি। সরকার যদি আমাদের পরিবারের কথা বিবেচনা করে ছেলের জন্য একটা চাকুরির ব্যবস্থা করে দিত তাহলে আমরা খেয়ে বাঁচতে পারতাম।’

তিনি আরো বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আন্দোলনে শহিদ ও আহতদের পরিবারকে নানাভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে। কিন্তু আমরা তো পাইলাম না। ছেলের চিকিৎসার জন্যে নেয়া ঋণ আমি কিভাবে শোধ করবো? জানি না।

তথ্যসূত্র: বাসস

#Tales_of_July

Post a Comment

Previous Post Next Post