বিবাহবার্ষিকীর দিন পোলাও-মুরগি রান্নার কথা বের হন মেরাজুল


সতরো বছর আগে ভালবেসে বিয়ে করেন নাজমীম ইসলাম ও দিনমজুর মেরাজুল ইসলাম। নগরীর একটি কলার দোকানে দিনমজুরের কাজ করতেন মেরাজুল (৩৬)। তার সামান্য আয় দিয়ে সুখেই চলছিল তাদের সংসার। 

বিয়ের ১৭ বছর পরেও এই দম্পতির গভীর ভালবাসা ও প্রেমময় সম্পর্ক এলাকায় এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল। প্রতিবেশীরা তাদেরকে এক আদর্শ দম্পতি হিসেবে ভালবাসতেন। 

গত ১৯ জুলাই ছিল নাজমীম-মেরাজুল দম্পতির ১৭তম বিবাহবার্ষিকী। এই দিনেই তৎকালীন স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পুলিশের গুলিতে স্বামীকে হারান নাজমীম(৩২)। সে থেকে এখনো কান্না থামেনি দুই পুত্র সন্তানের জননী নাজমীমের। একজন নারীর কাছে বিবাহবার্ষিকীতে স্বামীর মৃত্যু কতটা যন্ত্রণাদায়ক ও বেদনার তা হয়তো নাজমীমের চেয়ে আর বেশি কেউ জানেন না। দু’সন্তানসহ দিশেহারা নাজমীমের সামনে এখন কেবলই অন্ধকার ভবিষ্যৎ।

কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন গত ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ও অন্যতম ছাত্র সমন্বয়ক আবু সাঈদ শহিদ হওয়ার পর থেকেই রংপুরের সার্বিক পরিস্থিতি বিস্ফোরক হয়ে ওঠে। 

এ অবস্থায় গত ১৯ জুলাই (শুক্রবার) সকাল থেকে রংপুর নগরীর অবস্থা ছিল অস্বাভাবিক রবকমের শান্ত। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে যায় জুম্মার নামাজের পর। হঠাৎ বিকেল তিনটা থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের বিশাল বিশাল বিক্ষোভ মিছিলে হাজার হাজার শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতা-কর্মীরা অংশ নিয়ে রাজপথে নামেন। মূহূর্তেই গোটা নগরী উত্তাল হয়ে ওঠে।  

নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে বের হওয়া অসংখ্য মিছিল শাপলা চত্বর, গ্র্যান্ড হোটেল মোড়, জাহাজ কোম্পানি মোড়, পায়রা চত্বর, সুপার মার্কেট, রাজা রামমোহন মার্কেট, জেলা পরিষদ মিনি সুপার মার্কেট, সিটি মার্কেটসহ প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে শান্তিপূর্ণভাবে জিলা স্কুলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।

তখন পুলিশ বাহিনীর শত শত সশস্ত্র সদস্য আর্মড পার্সোনাল ক্যারিয়ার (এপিসি) নিয়ে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিলের বিপরীত দিক থেকে আক্রমণাত্মকভাবে ছুটে আসছিল। 

বিকাল ৪টার দিকে আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনের শত শত সশস্ত্র নেতা-কর্মী ও পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়। তখন পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে রূপ নেয়। 

বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে মেরাজুলের বাড়িতে চলছিল মুরগি ও পোলাও রান্নার প্রস্তুতি। নিজেদের মতো করে দিনটি উদযাপনে অনেক পরিকল্পনা ছিল দু’জনের। কিন্তু স্বৈরাচারের মাত্র একটা গুলি এই দম্পতির সাজানো সংসার তছনছ করে দিলো। 

বিবাহবার্ষিকীর রাতেই নিথর দেহে ফেরা স্বামীর কথা ভেবে এখনো শোকে স্তব্ধ হয়ে আছেন নাজমীম। তিনি তার দু’সন্তানকে নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় ভেঙ্গে পড়েছেন।

রংপুর নগরীর নিউ জুম্মাপাড়া এলাকার মৃত সামছুল হকের ছেলে মেরাজুল ইসলাম। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। মেরাজুলের মা আম্বিয়া খাতুন (৬৫) নিউ জুম্মাপাড়ায় স্বামীর বাসায় মেয়ে রাবেয়া খাতুন (৩৮) ও স্বামীর সাথে বসবাস করেন। মেরাজুলের বড় ভাই রমজান আলী (৪০) স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক পুত্র সন্তানকে সাথে নিয়ে ঢাকায় হোটেল ব্যবসা করেন। তার ছোট ভাই দিনমজুর মোহাম্মদ মাসুম (২৫) স্ত্রীকে নিয়ে মায়ের সাথে নিউ জুম্মাপাড়ায় পৈতৃক বাসায় থাকেন।

মেরাজুল তার স্ত্রী ও দুই পুত্র সন্তানকে নিয়ে পাশ্ববর্তী আমাশু কুকরুল এলাকায় দু’শতক জমির ওপর নির্মিত টিনের চালের বাড়িতে বাস করতেন। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করা মেরাজুল নগরীর সিটি বাজার এলাকায় পাইকারী কলা ব্যবসায়ী মহাজন জসিম উদ্দিনের কলার দোকানে একজন দিনমজুর হিসেবে তিন বছর ধরে কাজ করছিলেন। তিনি প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পারিশ্রমিক পেতেন। এর আগে তার নগরীর নিউ জুম্মাপাড়া এলাকায় পানের দোকান ছিল।

নগরীর নিউ জুম্মাপাড়া এলাকার মৃত নুরুল ইসলামের কন্যা নাজমীম ইসলাম দশম শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। 

এই দম্পতির তিন বছরের ছোট ছেলে মোহাম্মদ হানিফা। বড় ছেলে মেহরব হোসেন নাজিল (১৫) রংপুর সরকারী কারিগরী স্কুল ও কলেজের নবম শ্রেণির মেধাবী শিক্ষার্থী। মেরাজুলের ইচ্ছে ছিল নাজিলকে একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে গড়ে তোলা।

মেরাজুলের বড় বোন রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘আমার ভাইয়ের কী অপরাধ ছিল যে গুলি করে তাকে হত্যা করতে হবে? আমি আমার ভাই হত্যার দ্রুত বিচার চাই।’

মিরাজুলের মা আম্বিয়া খাতুন বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা ছোট থাকতেই স্বামীকে হারিয়েছি। কষ্ট করে ওদের বড়ো করেছি। ঐদিন শুক্রবার মেরাজুল তার মহাজনকে টাকা দিতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে শহিদ হলো। আমার নিরপরাধ ছেলেটার হত্যাকারীদের বিচার চাই।’

তথ্যসূত্র: বাসস

#Tales_of_July

Post a Comment

Previous Post Next Post