শহীদ সোহেলের অবুঝ শিশুটি বাসার গেটে দাঁড়িয়ে থাকে বাবা আসবে বলে, কিন্তু বাবা যে আর আসে না

 

ইত্তিহাদ এয়ারলাইন্সে উচ্চ পদে চাকরি করতেন সোহেল। ছিলেন নসট্রাম হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অনেক সামাজিক সংস্থার সাথে জড়িত। পরিবার নিয়ে অভিজাত এলাকা উত্তরায় বসবাস করতেন। কিন্তু সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের ওপর গুলির দৃশ্য দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেন নি। মৃত্যুর পূর্বে তাই বন্ধু ইব্রাহিম খলীল রনিকে ফোনে শেষ কথা

বলেছিলেন, ‘বিবেকের তাড়নায় ঘরে থাকতে পারছি না, আন্দোলনে যাচ্ছি। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে।’

আমাদের আজকের গণঅভ্যুত্থান গাথার নায়ক শহিদ মাহমুদুর রহমান খান সোহেল (৪৫)। যিনি বিত্ত-বৈভবের মাঝে বসবাস করেও সমাজের জন্য সবসময় চিন্তা করতেন। ১৬ থেকে ৩৫ জুলাই। পুরো আন্দোলনে সম্মুখ সমরে ছাত্রদের সাথে থেকে শেষ পর্যন্ত ৪ আগস্ট মাথায় গুলিবিদ্ধ হন এবং মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে করতে ৯ আগস্ট শুক্রবার চলে যান না ফেরার দেশে।

ঢাকার পাশে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ত্রিশকাহনিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম। মরহুম মো. লুৎফর রহমান খান ও সুরাইয়া আক্তার খানম দম্পতির সন্তান শহিদ সোহেল। বাবা-মা দু’জনকেই হারিয়েন।

তিনটি ফুটফুটে সন্তান নিয়ে ছিল তাঁর সংসার। বড় সন্তান মাসনূন রহমান খান (১২) ও মেজো মেয়ে সাফা (১০)। দু’জনেই উত্তরার উচ্চবিত্তদের ডিপিএস স্কুলে যথাক্রমে স্ট্যান্ডার্ড সিক্স এবং ফোরে পড়ছে।

ছোট সন্তান মারওয়া সূরা। বাবা যখন মারা যায় তখন তার বয়স ছিল মাত্র এক বছর চার মাস। সে বুঝেই না তার বাবা আর আসবে না। দরজার কলিং বেল বাজলে দৌড়ে যায় ‘বাবা বাবা’ বলে। যখন সারাদিনেও বাবা আর আসে না, সন্ধ্যার পরে সে অস্থির হয়ে যায়। বড় ভাইকে নিয়ে নিচে গেট পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাবা আসবে বলে। কিন্তু বাবা তো আর আসে না। ছোট বাচ্চা, বাবার অনুপস্থিতিটা বলে বোঝাতে পারে না।

সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র সাথে কথা হয় শহিদের স্ত্রী মরিয়ম খানম রাখির (৩৬) সাথে। উত্তরা ৬ নং সেক্টরের বাসার সুসজ্জিত বসার ঘরে বসে আমরা কথা বলছিলাম। চার বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। পাশেই তার বাবা অর্থাৎ শহিদ সোহেলের শ্বশুর বসা ছিলেন। ওপেন হার্ট সার্জারি করা রোগী তিনি। মেয়ের জামাই যখন মারা যায়, তখনও তিনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আমাদের সাথে কথা বলছিলেন এবং ঝরঝর করে কাঁদছিলেন। 

সোহেলের স্ত্রী বলছিলেন, ‘আমাদের পৈত্রিক নিবাস সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে। কিন্তু আমরা বড় হয়েছি নারায়ণগঞ্জের মাসদাইরে। 

তিনি বলেন, সে শুধু একটা কথাই বলতো, কারো কি বিবেক জাগ্রত হয় না? বিবেক কাজ করে না? যা হচ্ছিল দেশে, এটা সে কোনভাবে মানতে পারছিল না। প্রায় প্রতিদিন আন্দোলনরত বাচ্চাদের জন্য পানি, বিরানিসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যেত। দেশের পরিস্থিতি যখন খুব বেশি খারাপ হয়ে গেল, অফিস থেকে ছুটি দিয়ে দিলো হোম অফিস করার জন্য। কিন্তু বাসায় থাকতে পারতো না। ছটফট ছটফট করতো যে কি হচ্ছে এগুলো? দেশের জন্য, সমাজের জন্য কিছু একটা করতে হবে। এই চিন্তা সব সময় তার মধ্যে কাজ করতো।’

কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলতে থাকেন, ‘আমার বাচ্চারা বাবাকে দেখবে না। আর বাবা ডাক ডাকতে পারবে না। কথাগুলো যখন আমি চিন্তা করি, তখন অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু যখন সমাজের এই জিনিসগুলো আমি দেখতে পাই, কত মানুষের কষ্ট। তখন ভাবি, ওর আত্মত্যাগটা বৃথা যায় নাই। এইগুলা যখন চিন্তা করি তখন মনে হয়, না এগুলো নিশ্চয়ই ভালো কিছুর জন্য হয়েছে।’

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশেহারা তিনি। তাই বলতে থাকেন, ‘যদি ঘরে থেকে একটা কিছু করা যেত। আমি অনার্স পাস। আমার বাচ্চাগুলো যেন রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে কোনদিন বোঝা না হয়। ওর বাবা ওদেরকে অনেক সচ্ছলতার মাঝে বড় করেছে।’

বিজয়ের আগের দিন ৪ আগস্ট দুপুরে উত্তরার বিএনএস সেন্টারের সামনে গুলিবিদ্ধ হন সোহেল। রাজপথে তাঁর নিথর দেহ পড়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ততক্ষণে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। কিন্তু অনবরত গুলির মুখে সহযোদ্ধারা তাঁর কাছে যেতে পারছিল না। 

ঘটনাস্থলে উপস্থিত বস্ত্র প্রকৌশলী তালহা জুবায়ের বলেন, ‘আমরা পরে অনেক ঝুঁকি নিয়ে তাঁর দেহটা কোনমতে বাংলাদেশ মেডিকেলে নিয়ে যাই। পুরো আন্দোলনে তাঁকে আমরা পাশে পেয়েছি। তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন রকম খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আসতেন। আমরা আশ্চর্য হয়ে যেতাম, এরকম উচ্চবিত্ত পরিবারের একজন মানুষ সব ছেড়ে জনতার কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন।’

তারপর ৪ তারিখ বিকেলেই তাঁকে কচুক্ষেতের হাইটেক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় এবং ৫ তারিখ গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যায় রাখা হয়। এবং সেখানেই ৯ আগস্ট শুক্রবার রাত এগারোটায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। শনিবার সকালে তাঁর জন্মস্থান রূপগঞ্জে জানাজা শেষে মিরপুর ১১ নম্বর কবরস্থানে মায়ের কবরে শায়িত হন তিনি। 

মানুষের জন্য সর্বদা যার মন কাঁদতো, সেই শহিদ সোহেলের বড় সন্তান আমাদেরকে বলেন, ‘আল্লাহ আমার বাবার জন্য নিশ্চয়ই ভালো কিছু করবেন। আমার বাবা খুব ভালো ও সৎ মানুষ ছিলেন।

পরোপকারী মানুষ ছিলেন। আমাদের গ্রামে মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ করেছেন। যেহেতু আমি ছোটবেলা থেকে শুনেছি, যারা ভাল মানুষ হন তাদেরকে আল্লাহ তা'আলা খুব দ্রুত নিয়ে যান। কিন্তু আমার বাবা এত দ্রুত আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাবেন, আমরা ভাবতেও পারিনি।’

সহযোগিতা ও অন্যান্য প্রসঙ্গে শহিদের স্ত্রী বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লক্ষ টাকা এবং জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লক্ষ টাকা পেয়েছি। আমি যেহেতু শিক্ষিত, তাই শুধু একটি চাকরি চাই। সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকতে চাই। আমার বাচ্চাদের জন্য আপনারা একটু দোয়া করবেন, ওরা যেন ওর বাবার মত দেশের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করতে পারে। কারণ তাদের বাবা সারা জীবন মানুষের জন্য, দেশের জন্য, সমাজের জন্য চিন্তা করতো।’

সংবাদ: বাসস

 #Tales_of_July

Post a Comment

Previous Post Next Post