একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশেহারা শহীদ ওবায়দুলের পরিবার

 

জীবিকার তাগিদে দশ বছর আগে পরিবার নিয়ে গ্রাম ছেড়ে রাজধানীতে পাড়ি জমান ওবায়দুল ইসলাম (৫৪)। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার চর এলাকা চালিভাঙ্গা গ্রামে। বাবার নাম মৃত ওমর আলী।

স্ত্রী মরিয়ম বেগম (৪০), ছেলে মাজহারুল ইসলাম (২৫) ও একমাত্র মেয়ে মায়া (১৯)কে নিয়ে থাকতেন শনিরআখড়ার গোবিন্দপুর বাগানবাড়ীর ভাড়া বাসায়। সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালাতেন। একজনের রোজগার হলেও ভালোই চলছিল সংসার। কিন্তু এরই মধ্যে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গিয়ে শহীদ হন তিনি। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশেহারা পড়েছে তার পরিবার।

স্ত্রী মরিয়ম বেগম জানান, আন্দোলনের সময় যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় একধরনের বেকার সময় কাটছিল ওবায়দুল ইসলামের। বাসায় থেকে টেলিভিশন দেখে আর শুয়ে-বসে অলস সময় পার করছিলেন ওবায়দুল। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতাকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যার দৃশ্য তার চোখে পড়ে। এতে তার বিবেকে জেগে ওঠে। তাই সুযোগ পেলেই যাত্রাবাড়ী ও শনিরআখড়া এলাকায় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন।

প্রতিদিনের মতো সেদিন ৫ আগস্টও ওবায়দুল সরকার পতনের আন্দোলনে যোগ দিতে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা এলাকায় যান। মরিয়ম জানান, সেদিন দুপুরে জোহরের নামাজ পড়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হন ওবায়দুল। পরে জানতে পারেন, ওবায়দুল দুপুর আড়াইটায় যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গেলে পুলিশ ছাত্র-জনতার ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এ সময় ওবায়দুলসহ কমপক্ষে ৮-১০ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তখন কেউ হয়তো মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায় ওবায়দুলকে।

খবর পেয়ে রিকশায় করে দ্রুত ছুটে যান মরিয়ম। বিকাল সাড়ে ৪টায় হাসপাতালে পৌঁছেন। অসংখ্য লাশের সারির মাঝে স্বামী ওবায়দুলের মরদেহ শনাক্ত করতে পারেননি। শুধু তাই নয় এ নিয়ে মরিয়ম বেগমকে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। সেদিন লাশ খুঁজে পাননি। পরদিন দুপুর থেকে অনেক খোঁজাখুঁজির পর বিকাল ৪টার দিকে মর্গে লাশ দেখতে পান। তখনও কর্তৃপক্ষ নানা গড়িমসি করে। শেষ পর্যন্ত ওবায়দুলের এনআইডি কার্ড দেখে বিকাল ৫টার পর পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। তবে কোনো ধরনের পোস্টমর্টেম করা হয়নি।

মরিয়ম জানান, সেদিন রাতেই অ্যাম্বুলেন্সে করে স্বামীর লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি মেঘনার উদ্দেশে রওনা হন। মধ্যরাতে লাশ পৌঁছলেও জানাজায় অসংখ্য মুসল্লি অংশগ্রহণ করেন। এ সময় মেঘনা থানার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ উপস্থিত ছিলেন না। তবে এলাকার বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ গণমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।

ওবায়দুলের বিধবা স্ত্রী মরিয়ম জানান, তার স্বামীর মৃত্যুর পর পরিবারের চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন ওবায়দুল। একমাত্র ছেলে মাজহারুল ইসলাম লেখাপড়া তেমন করতে পারেননি। টুকটাক কাজ করেন। আর মেয়ে মায়া আক্তারকে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ে জামাই বশির ডেমরায় একটি দোকানে চাকরি করেন।

সরেজমিনে শনিরআখড়ার গোবিন্দপুরে ওবায়দুলের ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায় একটি বস্তিবাড়ীর ছোট্ট দুই রুমের বাসায় থাকেনতার স্ত্রী মরিয়ম, ছেলে মাজহারুল। বিয়ে হয়ে গেলেও তাদেও মেয়ে মায়া আক্তারও বেশিরভাগ সময় এখানেই থাকেন।

ছেলে মাজহারুল ইসলাম বলেন, তার বাবা সবসময় শিক্ষার্থীদের পক্ষে থেকেছেন। ২২ জুলাইয়ের পর থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের সাথে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। পরিবারের বাধাও মানেনি। তিনি জানান, তার বাবার মৃত্যুর ঘটনায় কোনো মামলায় হয়নি। তিনি তার বাবার হত্যার বিচার দাবি করেন।

ওবায়দুলের স্ত্রী মরিয়ম জানান, এখন পর্যন্ত জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ৫ লাখ টাকার অনুদান পেয়েছেন। আর সম্প্রতি কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যাবতীয় কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। জেলা প্রশাসক আমিরুল কায়সার কিছু অনুদান দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন অনুদান পেলেও তার স্বামীর শূন্যস্থান কখনও পূরণ হবে না। তাই অবিলম্বে খুনিদের শনাক্ত করে শাস্তি নিশ্চিত করতে তিনি সরকারের কাছে দাবি জানান।

মেঘনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হ্যাপী দাস জানান, ‘শহীদ ওবায়দুল ইসলামের পরিবারের সাথে আমাদের যোগোযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এরপরও সরকারের পক্ষ থেকে নতুন কোনো নির্দেশনা এলে আমরা সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।

সংবাদ: বাসস

#Tales_of_July

Post a Comment

Previous Post Next Post