ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন দেখে হলো না শহীদ আব্দুল্লাহ কবিরের

 


স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন দেখে যাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল শহীদ আব্দুল্লাহ কবির খানের। বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার কারণে বিগত প্রায় ১৬ বছর তিনি ছিলেন ঘরছাড়া। একটি রাত শান্তিতে বাসায় ঘুমাতে পারতেন না। তার নামে ছিল ৩৭ টি মামলা। ফলে পালিয়ে বেড়াতে হতো সারাক্ষণ।

জুলাই-আগস্টে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সবসময় সামনের সারিতে থাকতেন আব্দুল্লাহ। তার ইচ্ছা ছিল ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন দেখার। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটা দেখে যেতে পারেননি শহীদ আব্দুল্লাহ কবির খান। 

রাজধানীর মিরপুরের ১১ নং ওয়ার্ডের মধ্যপাইকপাড়ার বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস-এর প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ আব্দুল্লাহ কবির খানের স্ত্রী আফসানা আক্তার এসব কথা জানান। ঢাকা মহানগর উত্তরের ১১নং ওয়ার্ডের বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন আব্দুল্লাহ কবির খান।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক দফা দাবিতে চলমান আন্দোলনের সময়ে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বর আইডিয়াল স্কুলের সামনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আব্দুল্লাহ কবির (৪৮)। পরে ৬ আগস্ট গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর সদর উপজেলার হামানকর্দি গ্রামে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়।

শহীদ আব্দুল্লাহ কবির খানের স্ত্রী আফসানা আক্তার বলেন, আমার ছেলেটার বয়স ৮ বছর। ওর বাবা শহীদ হওয়ার পর থেকে সব সময় মন খারাপ করে থাকে। কিছু খেতে চায় না, বাবার কথা মনে হলেই কান্না শুরু করে। ওর বাবা যে আল্লাহর দরবারে চলে গেছে, সেটা কোনোভাবেই মানতে চায় না ছেলেটা। ছোট বাচ্চা, বুঝতে চায় না। কী করবো ছেলেটাকে নিয়ে? আসলে ছেলেটার ভবিষ্যত নিয়ে আমি অনেক চিন্তিত। 

তিনি বলেন, বিগত ১৬ বছর পুলিশের ভয়ে ওর বাবা বাড়ি থেকে পালিয়ে থেকেছে। বিএনপির রাজনীতি করার কারণে একের পর এক মামলা খেয়েছে। তারপরও যা আয় করেছে, বাসা ভাড়া, খাওয়া-দাওয়ার পেছনে খরচ করেছে। তা থেকে কিছু জমানো সম্ভব হয়নি।

আব্দুল্লাহ কবির খান ও তার স্ত্রী আফসানা আক্তার (৩৪)-এর একমাত্র ছেলে সন্তান আহনাফ খান (৮) মিরপুর পাইকপাড়া এলাকায় একটি মাদ্রসায় পড়ালেখা করে। শহীদ আব্দুল্লার কবিরের মায়ের নাম সুরাইয়া বেগম (৭২)। বাবা মো. মোছলেহ উদ্দিন অনেক আগেই মারা গেছেন। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে আব্দুল্লাহ ছিলেন বাবা-মায়ের পঞ্চম সন্তান।

সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আব্দুল্লাহ কবিরের স্ত্রী জানান, সেই দিন (৪ আগস্ট) ২ টা ১৭ মিনিটে আব্দুল্লাহর সাথে আমার শেষ কথা হয়। সে জানায় মিরপুর ১০ এলাকায় ছাত্র-জনতার সাথে আন্দোলেন আছেন। সেখানে পুলিশ ছাত্র জনতার উপর গুলি চালাচ্ছে। তখন আমি তাকে সাবধানে থাকতে বলি। আব্দুল্লাহ আমাকে বলে, দোয়া করো আমার জন্য। এই সরকারের পতন না ঘটিয়ে ঘরে ফিরব না।

পরে বিকেল ৩ টা ১০ মিনিটে অপরিচিত একটা নম্বর থেকে আমার ফোনে ফোন আসে। ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে আমাকে জানানো হয় আব্দুল্লার বুকের বামপাশে গুলি লেগেছে। আমরা তাকে মিরাপুর ম্যাক্স হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। আমি এই খবর শুনে চিৎকার করে কান্না শুরু করি। আমি বুঝে ফেলি- আমার স্বামী আর নেই। 

পরে আমার এক প্রতিবেশী এসে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। আমরা যখন ম্যাক্স হাসপাতালে পৌঁছব তখন আমাকে জানানো হয়, আব্দুল্লাহকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। লাশের ভিড় ও আহত রোগীদের ভিড়ে চিকিৎসা দিতে দেরি হওয়ায় অতিরিক্ত রক্ষক্ষরণ হয় আব্দুল্লাহর। পরে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আমরা কুর্মিটোলা হাসপাতালে পৌঁছে দেখি আমার স্বামীর মৃতদেহ ট্রলির ওপর পড়ে আছে। সারা শরীর রক্তে ভেজা।

আফসানা আক্তার বলেন, আমার স্বামী বলতো, বিগত ১৬ বছর ধরে বাসায় ঠিক মত ঘুমাতে পারিনি। এই সরকারের পতন না হলে আমার আরো বেশি সমস্যা হবে। তাই আমাকে আন্দোলনে থাকতেই হবে। এই সরকারের পতন ঘটাতেই হবে। সে সবসময় আন্দোলনকারি ছাত্র-জনতাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতো। পানি কিনে খাওয়াত। খাবার কিনে খাওয়াত। কেউ আহত হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেত।

তিনি বলেন, এত ছোট বয়সে ছেলেটা তার বাবাকে হারিয়েছে। আমার সংসার কীভাবে চলবে? আমিও কোনো চাকরি করি না। ছেলেটাকে কীভাবে পড়া লেখা শিখাবে? পড়ালেখা করাতে গেলে তো অনেক খরচ। আমি সেই খরচের টাকা পাব কোথায়? এখন ছেলেটার ভবিষ্যত কী হবে ? এই বলে সে কান্না করতে থাকেন তিনি।

ছেলের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না মা সুরাইয়া বেগম। তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আমার নির্দোষ ছেলেডারে মাইরা ফেলল। আমার বুক খালি কইরা দিল। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।

আন্তর্বর্তী সরকারে কাছে প্রত্যাশার বিষয়ে তিনি বলেন, আব্দুল্লাহর স্ত্রী ও ছেলেসহ আমাদের পরিবারের নিরাপদ ভবিষ্যত চাই। আমার বড় ছেলের আয় দিয়েই আমার সংসার চলত। এখন আমাদের সংসার কীভাবে চলবে? আমি অসুস্থ, মাসে অনেক টাকার ওষুধ লাগে, কীভাবে যে কী হবে আল্লাহ জানেন। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। 

শহীদ আব্দুল্লাহ কবিরের ছোট ভাই গাউস উল্লাহ রাজু বলেন, আমার ভাই পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি ছিলেন। তার একটি সন্তান রয়েছে। তাকে হারিয়ে পরিবার এখন দিশেহারা। কীভাবে তাদের সংসার চলবে এই চিন্তায় চোখে অন্ধকার দেখছি।

সংবাদ: বাসস

#Tales_of_July

Post a Comment

Previous Post Next Post