নাঈমা সুলতানার বয়স ১৬ বছর; ছিল মাইলস্টোন স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার অবসর কাটতো আঁকাআঁকিতে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরুতে বাসায় বসে বসে খাতায় নানা স্লোগান সংবলিত প্রতিবাদী ছবি এঁকে সময় পার করেছে। মারা যাওয়ার আগের দিন—১৮ জুলাই ২০২৪—উত্তরায় পুলিশের গুলিতে প্রায় ৩০ জন ছাত্র-জনতা মারা যায়। ওইদিন রাতে নাঈমা আন্দোলনের পোস্টার আঁকছিল, আর মায়ের সঙ্গে গল্প করছিল। একপর্যায়ে মাকে বলে, 'আম্মু, ধরো আমি যদি আন্দোলনে গিয়ে মারা যাই, তুমি মানুষকে কী বলবা?'
মাকে জবাব দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে আবার নিজেই বলে ওঠে, 'বলবা যে শহীদ হয়েছে। আমার মেয়ে শহীদ হয়েছে।'
নাঈমার বাবা বলেন, 'ওর মা তখন নাকি বলছিল, এসব তুমি কী বল, মা! আমরা তোমাকে বড় করছি ভালো কিছু করার জন্য। এসব আর বলো না। তুমি মারা যাবে কেন!'
উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে একটা বাসায় ভাড়ায় থাকত নাঈমারা। তাদের তিন ভাই-বোনকে নিয়ে মা থাকেন এ বাসায়। বাবা পল্লী চিকিৎসক, গ্রাম থেকে যাওয়া-আসার মধ্যে থাকেন। ভবনের চারতলায় থাকেন তারা।
১৯ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার। তাদের বাসার একটু দূরে উত্তরা আধুনিক মেডিকেলের সামনে ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশ ও তাদের সহযোগী ছাত্রলীগ-যুবলীগের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধলে অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ও কিছু পুলিশ আশপাশের গলিতে ঢুকে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। বিকেল আনুমানিক ৪টা। নাঈমা তার রুমে বসে 'বয়কট ছাত্রলীগ', 'কোটা সংস্কার চাই'সহ নানা স্লোগানে রঙিন কালিতে প্রতিবাদী পোস্টার আঁকছিল। আঁকাআঁকি থেকে উঠে মাকে জিজ্ঞেস করে, 'আম্মু, পিৎজা বানাবো। ফ্রিজে কী চিকেন আছে?'
মা হ্যাঁ বলায় সে বলে, 'আচ্ছা একটু পর বানাবো। বারান্দায় যাই একটু।' (সম্ভবত কাপড় আনতে বলছিল। বাবা স্মরণ করতে পারেননি, কী বলেছিল মাকে)। এ অবস্থায় বাসার সামনে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে দৌঁড়ে বারান্দায় আসে দেখতে। তার বাসার নিচে তখন আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি ছুঁড়ছিল। তখন হাতে থাকা মোবাইলে ভিডিও অন করে নিচের দিকে তাক করতেই তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে পুলিশ। গুলির আঘাতে মুহূর্তেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে নাঈমা।
নাঈমার মাথার একপাশ দিয়ে গুলি ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। মেঝেতে মগজ ছিটিয়ে পড়ে। গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে সে শুধু একটাই শব্দ করতে পেরেছিল, 'মা...আ...!'
পেছনে রুমে থাকা মা ও বড় বোন তার শেষ শব্দটি শুনে 'কী হইছে' বলে দৌঁড়ে বারান্দায় এসে দেখে, নাঈমা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ছে। মাথা দিয়ে রক্ত ঝরছে। সারা বারান্দায় ছড়িয়ে গেছে তার রক্ত।
মেয়ের এ অবস্থা দেখে মা জ্ঞান হারান। বোনের কান্নার আওয়াজে আশপাশের ফ্ল্যাট ও নিচে থাকা ছাত্ররা এসে ধরাধরি করে নাঈমাকে নিয়ে যায় উত্তরা আধুনিক মেডিকেলে। কিন্তু তার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় নাঈমা।
রাতেই নাঈমার মরদেহ নেওয়া হয় গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উত্তরের আমুয়াকান্দা গ্রামে। পথে পুলিশের নানা হয়রানির শিকার হতে হয় তাদের। কোথা থেকে এসেছে এ মরদেহ, কীভাবে মারা গেছে, কোথায় যাচ্ছে—নানা প্রশ্ন। পরদিন সকাল সাড়ে ৯টায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় নাঈমাকে।
নাঈমা ছিল মেধাবী। বাবার বর্ণনা, 'আমার মেয়েটা পড়ালেখায় খুব ভালো ছিল। বড় হয়ে ডাক্তার হতে চাইছিল। কোটা আন্দোলনে বাসা থেকে বের হতে ওর আম্মু নিষেধ করলে সে বাসায় বসে প্রতিবাদী ছবি আঁকতো। সেসব আবার ফেসবুকেও শেয়ার করতো। ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে মোবাইলে কল দিয়ে বান্ধবী ও ম্যাডামদের কাছে জেনে রেখেছিল, ওরা কোথায় আন্দোলনে থাকবে। যাতে পরদিন ও বের হতে পারে।'
লেখা: ফরিদ উদ্দিন রনি
প্রথম প্রকাশ: ডেইলি স্টার
Post a Comment