১৫ জুলাই : ঢাবিতে আহত হওয়া সাদমানের অভিজ্ঞতা

 


পেছন থেকে কেউ একজন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো, "অয় ও রাজাকার। অরে ধর!"


সবকিছু এত দ্রুত ঘটছে যে এই মুহূর্তের আলাপ না দিয়ে দু'মাস আগের কাসুন্দি ঘাঁটলে আপনারা ভ্রুকুটি নিক্ষেপ করবেন- এটিই অনুমেয়। তারপরও, কিছু অদ্ভুত মানুষ, কিছু অস্থির সময়ের কথা ভাবলাম লিখে রাখি। 

১৫ জুলাই, বেলা ৪ টা বেজে ১০ মিনিট সম্ভবত। ছাত্রলীগের রাজাকার নিধন কর্মসূচি চলছে পুরোদমে, পুরো ক্যাম্পাস জুড়েই বিক্ষিপ্তভাবে চলছে লীগের তাণ্ডব। টিএসসিতেই দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময়, হঠাৎ খবর এলো অমর একুশে হলের দিকে ছাত্ররা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। 

আমি এবং কয়েকজন প্রেসের ভাই তাদের সাথেই শহিদুল্লাহ হলের দিকে আগানো শুরু করলাম, উদ্দেশ্য টোকাইদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ। এমন সময়ে, পারমানবিক শক্তি কমিশনের সামনে মাথায় জাতীয় পতাকা বাঁধা এক তরুণকে ঘিরে জটলা দেখে পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। ঘিরে রাখা টোকাইবাহিনী তরুণের ফোন চেক করে ঘোষণা করলো এই ছেলে 'রাজাকার'। শুরু হলো বেদম পিটুনি। একজন নিরস্ত্র মানুষকে ২০-২৫ জন মানুষ হকিস্টিক, কাঠ, পাইপ দিয়ে বেধড়ক মারলে আসলে কী হয়- নিজের চোখে না দেখলে বোঝানো মুশকিল।

মারের এক পর্যায়ে ছেলের মাথা ফেটে রক্ত গড়িয়ে ফুটপাথ থেকে পড়তে লাগলো রাস্তায়। তারপরও পূর্ণ উদ্যমে রাজাকার নিধন চলছে। ঠিক এমন পর্যায়ে, এই মার.পিটের মাঝে ঢুকে বলার আমি এবং প্রেসের একজন ভাই মিলে চেষ্টা করলাম, ''ভাই আর মেরেন না, ছেলেটা মারা যাচ্ছে"। এবং এটি কোনো কথার কথা না, আসলেই ছেলেটি নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিলো।

আপনি বলতে পারেন, নিরস্ত্র অবস্থায় এতজন মানুষের মাঝে ঢুকে পড়া প্রথম শ্রেণির বেকুবি হয়েছে। আমিও মোটামুটি একমত। তবে, জীবনে এই ধরনের বেকুবি করেছি এবং ভবিষ্যতে আরো করার আশা রাখি বলেই বেঁচে থাকা আমার কাছে আনন্দের।

কোনোমতে কিল-ঘুষি, লাঠির বাড়ি খেতে খেতে তাকে বের করে আনা সম্ভব হলো। তার নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করার মতো অবস্থা তখন নেই, পুরো শরীর রক্তাক্ত। কোনোমতে একটি রিকশা ডেকে তাকে রিকশায় উঠিয়ে দিতে যাবো, এমন সময় পেছন থেকে কেউ একজন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো, "অয় ও রাজাকার। অরে ধর!"

এরপর যা হবার তাই। একই পরিণতির মাঝ দিয়েই যাওয়া লাগলো নিজেরও। প্রথমে দু'তিনজনের সাথে ধস্তাধস্তি করে দাঁড়িয়ে থাকলেও, এক পর্যায়ে একজন সরাসরি মাথায় হকিস্টিক দিয়ে আঘাত করলো। প্রথমে কিছু না বুঝলেও, পরক্ষণেই বুঝলাম, জখমটা থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এরপরের ঘটনার স্মৃতি কিছুটা আবছায়া। তবে, একজন মানুষ চিৎকার করে সবাইকে ডেকে বলছিলেন, ''ভাই, কেও এরে হাসপাতালে নেন, ছেলেটা মারা যাবে নইলে।"

আমার জীবন বাঁচাবার জন্য আমি এই মানুষটির সাথে কৃতজ্ঞ। আশা রাখি কোনোদিন তার সাথে দেখা হলে, অবশ্যই তাকে নিয়ে বিস্তারিত লেখার। 

উনি রিকশায় করে আমাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল যাবার পথে বাধলো আরেক বিপত্তি। কোনোভাবেই তারা ইমার্জেন্সিতে রাজাকারদের চিকিৎসা নিতে দেবে না। পরে আবার পুরোটা পথ ঘুরে চানখারপুল দিয়ে মেডিকেলে পৌঁছালাম। হাসপাতালের কাছে পৌঁছাবার আগেই রিকশা থেকে নেমে অনেকটুকু পথ হেঁটেই গেলাম, কীভাবে গিয়েছি, জানি না, সাথে যিনি ছিলেন, তিনিই ভালো বলতে পারবেন। 

ঢাকা মেডিকেলে দেখা হলো বন্ধু সিয়াম, আকিল ভাইও ছিলেন। জাহিদ, শেখ, আব্দুল্লাহ, সৌরভ, আখতার, দ্যুতি, পরমা, পাপড়ি, অর্পিতা, মুজতাবা, তাজরিয়ানসহ যারা সেদিন এই চরম বিপদের মাঝে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল এসেছিলেন, আপনাদের প্রতি আমি ঋণী। এর বেশি কিছু আমি বলে বোঝাতে পারবো না, সম্ভবও না। শুধু আল্লাহর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা, আমার জীবনের বন্ধু ভাগ্য সত্যিই অসম্ভব ভালো। একইসাথে জুয়েল স্যার, আনোয়ারুল আজিম স্যার এবং তানজীম স্যার- আপনারা যেভাবে নিজেদের চাকরির মায়া না করে আমার জন্য প্রতিবাদ করেছিলেন, আপনাদের প্রতি জানাই কুর্নিশ! 

মাথায় আটটি সেলাই নিয়ে মুজতাবার বাসায় হাজির হলাম। সেখানে কিছুক্ষণ থেকে মাহ্‌দী, সৌরভ, মুজতাবা বাসায় দিয়ে গেলো। এতকিছুর মাঝে, কে ওষুধপত্র কিনেছে, কে উবার ভাড়া দিয়েছে- কিছুই জানি না। তবে মুজতাবা এবং আরো কয়েকজন বোধহয় আমার কাছে হাজারখানেক টাকা পাবে, যা এখনো দেয়া হয় নি, তারাও কোনোদিন চায় নি। মূল বিপত্তি বাঁধলো বাসায় আসবার পর। 

রাজনৈতিক লিংক লবিংবিহীন ছা-পোষা একজন সরকারী কর্মকর্তার ছেলে হওয়ায় একটা পিছুটান সবসময়েই ছিলো। তনু হত্যার বিচার দাবী থেকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন; সবসময়ই মাথায় ছিলো- রাজপথে মার খাই, জখম হই- কিন্তু কোনোভাবেই মামলা খাওয়া কীংবা অ্যারেস্ট হওয়া যাবে না।

তাই, গ্রেফতার এড়াতে দুর্ঘটনার দিন বাসায় আসবার সময় গায়ে ঢাবির লোগো সম্বলিত জার্সি ছিলো, তা পাল্টাতে হয়েছিলো শুরুতেই। আমাকে নিয়ে আসা সৌরভ, মাহ্‌দী, মুজতাবাকে বাবা বিদায় দিলো রীতিমতো চোরের মতো। 

আশেপাশের সবার থেকে লুকিয়ে, অনেকটা ফেরারী আসামীর মতো দিন কাটানো শুরু করলাম। হাসপাতালে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে, মিথ্যা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে চিকিৎসা নেয়ার চেষ্টা করেও বিফল হলাম। পরে নানা অনুনয় বিনয় করে একটি হাসপাতালে সিটিস্ক্যান করানো গেলো। এরপর ইনফেকশন থাকায়, আবার সেই সেলাই কাটা, আবার সেলাই করা, চোরের মতো হাসপাতালে যাওয়া-আসা...

 কী সব দিনই না পেছনে ফেলে এসেছি!

অনেকবারই ভেবেছি লিখবো না। এতদিন তাই লিখিও নি, পরিবারের এবং সেই দুঃসহ সময়ের সঙ্গী কিছু মানুষ ছাড়া এতদিন কেউ পুরো ঘটনা জানতোও না। তবু মনে হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশিরভাগ পাবলিকে মৃত্যুর খতিয়ান শূন্য হওয়ায়, কেউ 'মারা না যাওয়ায় হতাশায়', কবে না কে যেন বলে বসেন, "এরা কেউ তো আন্দোলনই করে নি!''

সাদমান মুজতবা রাফিদ, 

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

#Tales_of_July

Post a Comment

Previous Post Next Post