স্রষ্টার নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শুরু করছি, কেননা বেঁচে আছি, সুস্থ আছি এবং মুক্ত বাতাসে বিচরণ করে যাচ্ছি স্বাধীন ভাবে। কত প্রশান্তি ও ভালো লাগা কাজ করছে তা হয়তো বুঝতেই পারতাম না যদি আমার ভাইয়েরা আত্মোৎসর্গ না করতো, যদি বোনরা রক্ত না দিতো। এক যুগের বেশি সময় ধরে অত্যাচারিত , নির্যাতিত, নিপীড়িত ও নিষ্পেষিত হয়েও কেউ কোনো আওয়াজ তুলার সাহস পাচ্ছিলো না, দুই একে তুললেও তারা কোথায় যেনো চলে যেতো কোনো এক নাম না জানা ঘরে! এতো এতো সময় মুখ বুঝে সহ্য করলেও শিক্ষার্থীদের সাথে হয়ে আসা অন্যায় কেন যেন আর সহ্য হচ্ছিল না। সকল সীমা ছাড়িয়ে গেল, শুরু হয়ে গেল এক আন্দোলন। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বরাবরের মতই ছত্রাকের আক্রমণ হয় খুব খারাপ ভাবে, অন্য দিকে তাদের অভিভাবকও আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। ব্যাপকভাবে প্রতিবাদ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে কিন্তু একটা জায়গায় এখনো কোনো প্রতিবাদ হচ্ছিল না, বলা হয়ে থাকে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকেই এখানে আওয়ামীলীগেরা ক্ষমতায়। আমাদের প্রিয় শ্রীপুর, দ্বিতীয় মা!
জুলাই এর ১৬ তারিখ থেকেই প্রতিনিয়ত ভিতরে ভিতরে পুড়েছে, সুবোধ খেয়েছে মাথা-মগজ কে, কেন কেউ কিছু বলছে না, কেন প্রতিবাদ হচ্ছে না! আর কতো চুপ করে থাকবো, আর কতো রাত না ঘুমিয়ে পার করবো! নিজের বড় ভাই বোনদের উপর হওয়া নির্যাতনের প্রতিবাদও কি করতে পারবো না! অনেক প্রতীক্ষার পর প্রায় ৪৮ ঘন্টা পর আমরা প্রথম রাজপথে নামতে সক্ষম হই। ১৮ই জুলাই, প্রচন্ড রোদ ছিল, রোদের তীব্রতায় দেখেছিলাম রাজপথের পিচ গলে যাচ্ছে, কিছুক্ষণ পর পর অনেক ভাইয়েরা পানি খাওয়াচ্ছিল, ওয়াপদা মোড়ের পল্লী বিদ্যুৎ এর সামনে এক দোকানদার ভাই দুই ডাম ভর্তি ঠান্ডা পানি নিয়ে বসেছিল শুধুমাত্র ছাত্র ভাই-বোনদের একটু স্বস্তি দিতে। সারাদিন রোদে পুড়ে প্রতিবাদ জানানো কিছুক্ষণ পর পর থানার ওসি এসে আমাদের চলে যেতে বলছিল কিন্তু আমার সাহসী ভাইয়েরা তার কথা প্রত্যাখ্যান করেছে দফায় দফায়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো অনেকে চলে গেছে আবার অনেকে আসতেছে খাওয়া দাওয়া করে, সাথের বোনদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো। আমরাও চলে আসার সময় সাথের ভাইকে থানার ওসি বললো ওকে দেখে নিবে, থানায় এসো ইত্যাদি ইত্যাদি।
সবাইকে এই বলে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে পরবর্তী প্রতিবাদ/আন্দোলন আমরা কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ভাইদের নির্দেশনা অনুযায়ী করবো। কিন্তু আফসোস, বাড়িতে এসে দেখি ওয়াইফাই ইন্টারনেট কিছুই চলছে না, নিজেদের বিচক্ষণতার অভাবে ১৮ই জুলাই থেকে ৩১শে জুলাই পর্যন্ত এই দীর্ঘ দিন ঘরে বসে পার করতে হয়। কোনো প্রতিবাদ সমাবেশ কিছুই করতে পারিনি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ, কীভাবে কী করা যায়, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। নিজেদের দূরদর্শিতার অভাবে শ্রীপুরের মাটিতে এতো দিন কোনো প্রতিবাদ ই করা হয়নি। অনেক খারাপ লাগছিল, লজ্জা হচ্ছিল নিজেদের প্রতি, অনেক অপেক্ষার পর ইন্টারনেট চালু হবার পর পরই বাড়ির পাশের যারা ছিল তাদের সাথে পরামর্শ করেই মেসেঞ্জার গ্ৰুপ খুলে ফেলা হয়, আশেপাশের পরিচিত সবাইকে যুক্ত করা হয় গ্ৰুপটিতে, রাতভর আলোচনা হয় কিভাবে কী করা যায়। আমাদের মতো এমন আরো অনেকেই তাদের নিজ নিজ এলাকা ও পরিচিত মানুষের নিয়েও এমন গ্ৰুপে খুলে ফেলেছিল ইন্টারনেট চালু হবার পর পরই। আন্দোলন এর ডাক দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী, ৩ আগষ্ট। সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়, পিয়ার আলী কলেজ, শ্রীপুর কলেজ, আওয়াল কলেজ আশেপাশের সকল সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে, আমরা মাওনার ওয়াপদা মোড়ে গিয়ে দেখি ৫/৬ জন আমরা আমরাই, তারপর দেখতে পেলাম আরো ৮/৯ জন আলাদা আলাদা এসেছে, তাদের নিয়ে যখন ১৫/২০ জনের মতো হয় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে দেওয়া হয়,১০ মিনিট পরই পিয়ার আলী কলেজ থেকে আমাদের অন্য ছাত্র ভাই বোনরা মিছিল নিয়ে আসে, আমরা একসাথে হই।
মিছিল নিয়ে মাওনা চৌরাস্তায় গিয়ে দেখি আ'লীগের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা মিছিল করছে, পুলিশ আমাদের বাঁধা দিতে এসেছিল কিন্তু পরে সরে গেছে। আমরা ফ্লাইওভারের নিচে দিয়ে ঘুরে ওয়াপদা আসি, কিছুক্ষণ পর শুনতে পেলাম লীগের কর্মীরা আমাদের দিকে মিছিল নিয়ে আসতেছে, আমার ভাই-বোনদের রক্ত মুহূর্তে টগবগিয়ে উঠলো, আমরাও তাদের দিকে ছুটে যাই মিছিল নিয়ে, কাঁচাবাজারের সামনে তাদের সাথে মুখোমুখি একটু একটু হাতাহাতি হয়ে মুহূর্তে তাদের কে আমরা বাধ্য করি মিছিল বন্ধ করতে, তারাও তোপের মুখে পড়ে মিছিল ছেড়ে দেয় ও চলে যায়। কিছুক্ষণ মিছিল চলার পর পুলিশ ও আমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাচ্ছিলো । কিন্তু আমার ভাইদের রক্ত লেগে আছে তাদের হাতে, তাই অনেকে পরিস্থিতি শান্ত রাখতে চেয়েছে আবার যাদের যন্ত্রণা বেশি ছিল তারা পুলিশকে সহ্য করতে পারছিল না। কয়েক দফা পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়, অতঃপর একটা সময় পুলিশ আর চুপ থাকে না। ওপেন ফায়ারিং শুরু করে, চোখের সামনে ৬ জন ভাই রক্তে লাল হয়ে যায়! তাদের কে অন্যরা হাসপাতালে নিয়ে যায়,আর কিছুক্ষণ পর পরই টিয়ার শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। চোখের সামনে সাজানো গুছানো মাওনা চৌরাস্তা যেন রণক্ষেত্র হয়ে উঠে, পুলিশের ফায়ারিং করার পর অনেক সহযোদ্ধারা প্রায় ৯০/৯৬ ভাগই মাওনা ছেড়ে দেয়, ওয়াপদা মোড়ে চলে যায়, কিন্তু যেতে পারছিলাম না, আমার ভাইদের রক্ত ঝরেছে এখানে। কীভাবে যাবো আমি বুঝতে পারছিলাম না, সাথের সহযোদ্ধাকে খুঁজেও পাচ্ছিলাম না, তাকে খুঁজার জন্য সামনে অগ্ৰসর হই। যেদিকে ফায়ারিং হচ্ছিল সেদিকে যাই, বাঁচবো কিনা বুঝতেও পারছিলাম না।
কিছুদূর গিয়ে দেখি ঐদিকের সবাই আমার দিকে দৌড়ে আসছে, পিছনে একটু দৌড় দিয়ে খেয়াল হলো আমি তো একজন কে খুঁজতে এসেছি। আবার সামনে যাই, গিয়ে দেখি সে আহতদের উদ্ধার করা তারপর পুলিশের নিক্ষেপ করা টিয়ার শেল আবার পুলিশের দিকে ছোড়ার জন্য ব্যস্ত। তাকে পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে খাপ করে ধরে ফেললাম, মুহূর্তের মধ্যেই আবার ফায়ারিং শুরু, কোথায় থেকে যেন এক ইটের টুকরো আমার মাথায় এসে জোরে লাগে। ভেবেছিলাম গুলি বোধহয় লেগেছে তখন এই অবস্থা থেকে বের হতে দুইজন শুধু পিছনের দিকে ঘুরে দৌড় দিবো, এমন সময় হোঁচট খেয়ে ফুটপাতের উপর দুজন পড়ে শুয়ে পড়ি। তাৎক্ষণিক উঠার সময় নাক দিয়ে জোরপূর্বক এক শয়তানের ধোঁয়া ঢুকে পড়ে, সাথে সাথেই দুজনের শ্বাস প্রশ্বাস আর চোখ একবারেই যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, অনেক কষ্টে মোড় পর্যন্ত এসে আগুনের সামনে দাড়াই, কিছুটা স্বস্তি পেলাম। অতঃপর দিনের বাকি অংশে আরো অনেক কিছুই হয়েছে, বিশেষভাবে পুলিশ ফাঁড়িতে। ঐখান থেকে যে বেঁচে ফিরেছি এটাই স্রষ্টার নিকট কৃতজ্ঞতা, চোখের সামনে দুজন শুয়ে পড়েছে। সন্ধ্যার পর পর্যন্তও চলেছে আন্দোলন, পরেরদিন সকাল মাওনা চৌরাস্তায় লীগেরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মিছিল করেছে, ছাত্রদের পিটিয়েছে। মেরে ফেলার জন্য তাড়া করেছে,অনেকে কপালের জোরে বেঁচে গেছে শুধু। আন্দোলন শেষ করে বাড়িতে আসার পর জানা যায় লং মার্চের ডাক এসেছে, আগে মার্চের তারিখ ৬ই আগস্ট ছিল কিন্তু ঐটা পরিবর্তন করে ৫ আগস্ট দেওয়া হয়।সকল গ্ৰুপে জানিয়ে দেওয়া হলো। কীভাবে যাবো, কখন যাবো ,কার সাথে যাবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করেও লাভ হলো না, শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হয়নি, মন খারাপ করে বাড়িতেই ছিলাম।আর শুনতে পেলাম যে মাওনা চৌরাস্তায় সাধারণ জনতা, শ্রমিক আর ছাত্রদের একাংশ আজকেও আন্দোলন করছে। দুপুরের পর পরই খবর পেলাম দেশ থেকে পালিয়ে গেছে স্বৈরাচারী খুনি হাসিনা! আহ আনন্দের আর কোনো সীমা রইল না, এ যেন বছরের মাঝখানে ঈদের আগমন। সবাই রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে আনন্দ উল্লাসের জন্য, কিন্তু এই আনন্দ আর বেশি সময় রইলো না। প্রশিকার মোড়ের দিকে যেতেই দেখি রক্ত, রক্ত! আমরা এখন স্বাধীন!তাহলে কিসের রক্ত? শুনতে পেলাম বিজিবির সাথে সংঘর্ষ হয়েছে আন্দোলনকারীদের, কিছুক্ষণ মোড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রক্তে ভেজা ভাইদের দেখার পর আর ভালো লাগছিল না, তাই সামনে অগ্ৰসর হই! অবদা মোড়ে ঢুকে শুধু মহাসড়কে পা রেখেছি এমন সময় শত শত মানুষ আমাদের দিকে দৌড়ে আসছে, দৌড় দেওয়ার এক সেকেন্ড পরই ফায়ারিং এর বিকট আওয়াজ, মুহূর্তেই তাজা প্রাণ গুলো লাশ হয়ে গেল! কোনো রকম বেঁচে এক মসজিদের ভেতর অবস্থান নেওয়া হয়, মসজিদের মাইক দিয়ে ঘোষণাও করা হয় আমরা তাদের কোনো ক্ষতি করবো না, তাদের রাস্তা দেওয়া হবে। তারা যেন চলে যায়, কিন্তু কোনো কাজ হলো না। এমন চলতেই থাকে, পর পরই বিজিবির তিনটি বড়ো বড়ো হেলিকপ্টার চলে আসে, মাথার উপর দিয়ে ঘুরতে থাকে। এই অবস্থা দেখে আর ভালো লাগছিলো না, বাড়ি থেকেও প্রচুর রাগারাগি করছিল। স্বাধীন হওয়ার পরেও এতো কিছু নিতে পারছিলাম না,আর রক্ত সহ্য হচ্ছিল না। আন্দোলন ভূমি কে সালাম জানিয়ে চলে আসি, আবার হয়তো কোনো একদিন দেখা হবে তার সাথে। ভালো থেকো!
#Tales_of_July
Post a Comment